কুম্ভলগড় এর মর্মান্তিক ইতিহাস .. The Sad Story Of Kumbhalgarh.. ( INDIAN HISTORY )
ছোটবেলা থেকে
আমরা জেনে এসেছি প্রথম যে হয় তাকে সবাই মনে
রাখে। যে দ্বিতীয় হয় তাকে কেউ মনে রাখে না। যেমন চাঁদে
যাওয়া প্রথম মানুষ নীল আর্মস্ট্রং আমরা
সবাই জানি। কিন্তু দ্বিতীয় কে ? এডউইন অলড্রিন। কতজন মনে রাখি আমরা ? খুব কম লোকই জানে।
সেরকমই একটা উদাহরণ আছে। পৃথিবী র সব
চেয়ে লম্বা প্রাচীর কি ? চীন এর প্রাচীর। চীন
এর প্রাচীর নিয়ে অনেক গল্প অনেক লেখা। আর তা
দেখতে সারা বছর নানা দেশের পর্যটক। কিন্তু
দ্বিতীয় লম্বা প্রাচীর কি ? কতজন জানি ? হ্যা দ্বিতীয় লম্বা প্রাচীর টা আমাদের দেশে এই ভারতবর্ষেই আছে।
কুম্ভলগড়
দুর্গের নাম হয়তো অনেকেই শোনেন নি। তা
নিয়ে খুব বেশি লেখালিখিও তেমন হয়না। রাজস্থান
ঘুরতে গেলে আমরা কুম্ভলগড় এর কথা মাথায়
রাখি না। পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রাচীর
আছে এই কুম্ভলগড় দুর্গেই।
কুম্ভলগড় দুর্গ ভারতের
রাজস্থান এর মেবার এ
অবস্থিত। মাটি
থেকে প্রায় ১১০০ মিটার উচ্চতায়
তৈরী এই পাহাড় ঘেড়া দুর্গ।
আর তার প্রাচীর ৩৬ কিলোমিটার লম্বা।
যা দৈর্ঘে চীনের প্রাচীর এর পরেই। কুম্ভলগড়
দুর্গের প্রাচীর প্রায় ১৫ ফুট চওড়া। পাশাপাশি ১০ টা ঘোড়া চলতে পারে এই প্রাচীর এর ওপর
দিয়ে একসাথে।
কুম্ভলগড়
দুর্গ তৈরী করেছিলেন রানা কুম্ভ। মৌর্য
রাজ ও সম্রাট অশোক
এর পুত্র সামপ্রতি র বানানো একটি
দুর্গের ভগ্নাবশেষ এর ওপর এই
দুর্গ তৈরী করেছিলেন রানা কুম্ভ। এই দুর্গটির সম্পূর্ণ
নির্মাণে 15 বছর লেগেছিল (1443-1458)। দুর্গটির
নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার পরে, মহরানা কুম্ভ
মুদ্রা তৈরি করেছিলেন যার উপরে দুর্গ এবং নাম লেখা ছিল। দূর্গটি অনেক
উপত্যকা ও
পাহাড় এর সাথে যুক্ত
হয়ে নির্মিত হয়েছে। এই দুর্গের উঁচু
স্থান গুলো তে মন্দির, প্রাসাদ,
আবাসিক স্থান গুলো বানানো হয়েছিল। প্রাকৃতিক
প্রতিরক্ষামূলক সুবিধা
গুলো পাওয়ার জন্য এই দুর্গ ছিল
প্রায় অজেয়।
কুম্ভলগড়
দুর্গের প্রাচীরের রয়েছে ৬টি বিশাল দরজা যার সাহায্যে এই দুর্গের ভিতরে
প্রবেশ করা হতো। এই দুর্গের মধ্যে
আরও একটি দুর্গ রয়েছে যা কাতারগড় নামে
পরিচিত, এই দুর্গটি সাতটি
বিশাল ফটক এবং খাঁটি উপদ্বারা সুরক্ষিত। কুম্ভলগড় দুর্গের সবচেয়েউচ্চতম স্থানে
নির্মাণ করা হয়েছে বাদল মহল যাকে মহারানার কুম্ভ মহলও বলা হয়। এই দুর্গ কে
স্বাবলম্বী বানানোর জন্য দুর্গের ভেতরেই চাষ এর ব্যবস্থা আর
জলাশয় এর
ব্যবস্থা করা হয়েছিল। দুর্গের ভেতরে ৩৬০ টি র ও
বেশি মন্দির আছে। যার
বেশির ভাগ ই জৈন মন্দির আর বাকি গুলো
হিন্দু মন্দির। এমন একটি বিশ্বাস রয়েছে যে, মহারাণ কুম্ভ এই দুর্গে রাত্রি
শ্রমিকদের জন্য 50 কেজি ঘি এবং 100 কেজি
তুলা ব্যবহার করতেন, যা জ্বালিয়ে প্রদীপ
জ্বালিয়ে দিতেন। কুম্ভলগড় দুর্গ মেবার এর সংকটসময় এর রাজধানী হয়ে গিয়েছিল। মহরানা কুম্ভ থেকে শুরু
করে মহরানা রাজ সিংহ অবধি এই কুম্ভলগড় দুর্গেই বসবাস করতেন। পৃথ্বীরাজ ও মহরানা সাঙ্গা এর শৈশব ও এখানেই কেটেছিল। শোনা যায় এই দুর্গে লুকিয়েই রানা উদয় সিংহ এর লালন পালন করেছিলেন পান্না ধাঁই।
হালদিঘাট এর যুদ্ধে পরাজয় এর পর মহরানা প্রতাপ এই দুর্গেই দীর্ঘকাল কাটিয়েছিলেন।
কুম্ভলগড়
দুর্গ তৈরির একটি মর্মান্তিক ইতিহাস আছে। শোনা
যায় যখন ১৪৩৩ সালে মহরানা কুম্ভ কুম্ভলগড় দুর্গ তৈরী শুরু করেছিলেন তখন নানা কারণ এ নির্মাণ কাজ কিছুতেই এগোচ্ছিল
না। বার বার নানা কারণ এ কুম্ভলগড় দুর্গ বাধার
সম্মুখীন হচ্ছিলো। এই নিয়ে রানা কুম্ভ খুব
চিন্তিত হয়ে পড়েন। একদিন এই বিষয় এ আলোচনার
জন্য তিনি এক সাধু র শরণাপন্ন হন। সেই সাধু
রানা কুম্ভের থেকে সব শুনে বলেন এই নির্মাণ কাজ শেষ করার একটাই রাস্তা আছে। যদি কোনো ব্যক্তি স্বেচ্ছায় নিজেকে বলিদান করেন
তাহলে এই দুর্গ তৈরী সম্পূর্ণ হবে। রানা কুম্ভ
পড়লেন মহা চিন্তায়। কে এমন লোক আছেন যিনি এই দুর্গের জন্য স্বেচ্ছায় নিজেকে বলিদান দেবেন ? তখন সেই সাধু রানা কুম্ভ
কে আশ্বস্ত করে জানান তিনি নিজে রাজি আছেন
এই বলিদান দিতে। কিন্তু তার শর্ত আছে। সাধু বলেছিলেন যে তাঁকে পাহাড়ের উপর দিয়ে হেঁটে
যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হোক এবং যেখানেই তিনি
ক্লান্ত হয়ে থামবেন সেখানেই তাকে হত্যা করতে
হবে এবং সেখানে দেবীর মন্দির তৈরি করা হবে।
নিরুপায় হয়ে রানা তাতে রাজি হলেন। এবার
একদিন সেই সাধু পাহাড় ওপর দিয়ে হাঁটা শুরু
করলেন। পেছনে তার রানা কুম্ভের সৈন্য। হাঁটতে
হাঁটতে তিনি ক্লান্ত হয়ে থামলেন ৩৬
কিলোমিটার পরে। আর যেখানে থামলেন সেখানেই তার শিরোশ্ছেদ করা হলো। আর সেই জায়গায় বানানো হলো মন্দির। সাধু র মাথা যেখানে পড়েছিল সেখানে একটি ফটক বানানো
হয়। তার নাম দেওয়া হয় "হনুমান পোল
" , আর দেহ যেখানে পড়েছিল সেখানেও একটি
মুখ্য ফটক আছে।
কুম্ভলগড়
দুর্গ তৈরীর পর থেকে শুরু হয়ে গিয়েছিলো এই দুর্গের ওপর বাইরের আক্রমণ। কিন্তু একবার
বাদে প্রতিবার ই এই দুর্গ ছিল অজেয়। কিন্তু
সেই একবারও কুম্ভলগড় দুর্গ অজেয় থাকতো। সেই যুদ্ধে দুর্গের বাইরের আক্রমণ ছিল চারজন রাজার। দুর্গের বাইরে ঘিরে ছিলেন তখন মোগল সম্রাট আকবর
, আমের এর রাজা মান সিংহ , মেবার এর উদয় সিংহ
আর তাদের সহযোগী গুজরাট এর সুলতান। কিন্তু
সেই সময় দিনের পর দিন থাকার পর পানীয় জল এর আকাল
পরে যায় দুর্গের ভেতরে। আর এই পানীয় জল এর দুর্গ দ্বার খুলতে হয়।
কুম্ভলগড়
দুর্গের কিছু দুঃখ জনক ঘটনাও আছে। যেই মহারানা কুম্ভ কে বাইরের কোনো শক্তি পরাস্ত
করতে পারেনি সেই মহারানা কুম্ভকে নিজের ছেলে উদয় সিংহ রাজ্য লিপ্সায়
হত্যা করেন। কিন্তু এই দুর্গ তৈরী তে
সাধু র আত্মত্যাগ এর গল্প টি হলো সব চেয়ে বিষাদময়। সেই সময় এর বিশ্বাস অনুযায়ী হয়তো এটা না করলে ভারতের এই গর্বের দুর্গ টি তৈরী ই হতো না। ২০১৩ সাল এ এই কেল্লা টিকে world heritage site হিসেবে ঘোষণা করা হয়। মহারানা কুম্ভ রাজ্যে রয়েছে ৮৪টি বিশাল কেল্লা যার
মধ্যে ৩৪ টি কেল্লার নকশা তিনি নিজেই বানিয়েছিলেন। আর এই কুম্ভলগড়ের প্রাচির মহারানা
কুম্ভের একটি অনবদ্য সৃষ্টি যা আজ পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রাচীর হিসাবেই সারা বিশ্বে
পরিচিত হয়ে আছে।
Reference : internet
copyright: Pinaki Ghosh
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Please do not enter any spam link in comment box