পিতৃপক্ষ ও কিছু কথা

 


 

 

 

 পিতৃপক্ষ এই শব্দটির সাথে আমরা বেশ পরিচিত। মহালয়ার দিন পিতৃপক্ষের শেষ দিন এবং ঠিক তার পরের দিনটি থেকে দেবীপক্ষের শুরু।
কিন্তু এই পিতৃপক্ষ আসলে কি?  এর সুচনা কিভাবে হলো? আমাদের বর্তমান প্রজন্ম কতটা জানে হিন্দু ধর্মের এই অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে? অবশ্য ইন্টারনেট আর গুগলের দৌলতে আজ আর অজানা কিছুই নেই, তবুও আজ এই পিতৃপক্ষ নিয়ে কিছু কথা বলতে মন চাইছে। এখন যেহেতু পিতৃপক্ষ চলছে তাই সময়োপযোগী হবে....
প্রথমে বলি পিতৃপক্ষের "পক্ষ" কথাটির মানে ১৫ দিন, মানে এক পক্ষ হয় ১৫ দিনে। এক বছরে ১২ টি মাস থাকে আমরা জানি।এই ১২ মাসে থাকে ২৪ টি পক্ষ, যার মধ্যে ২ টি পক্ষের বিশেষ তাৎপর্য আছে।সেই পক্ষ দুটি হলো পিতৃপক্ষ ও দেবীপক্ষ।
পিতৃপক্ষ ছাড়াও এই পক্ষ পিত্রুপক্ষ, ষোলো শ্রাদ্ধ, কানাগাত,জিতিয়া,অপর পক্ষ ও মহালয়া পক্ষ নামেও পরিচিত। আশ্বিন মাসের কৃষ্ণ পক্ষের তিথিকে মহালয়া বলে। মহালয়া পক্ষের ১৫টি তিথির নাম প্রতিপদ, দ্বিতীয়া,তৃতীয়া,চতুর্থী, পঞ্চমী, ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী, দশমী,একাদশী,দ্বাদশী, ত্রয়োদশী,চতুর্দশী ও অমাবস্যা। প্রতিপদ থেকে অমাবস্যা এই ১৫ টি দিন পিতৃপক্ষ।দক্ষিন ও পশ্চিম ভারতে গনেশ উৎসবের পরের ভাদ্র পূর্নিমা তিথিতে এই পিতৃপক্ষ শুরু হয় এবং শেষ হয় পিতৃ অমাবস্যা বা মহালয়ার দিন।এই বছর মানে ২০২০ সালে ২ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয়েছে পিতৃপক্ষ শেষ হবে ১৭ সেপ্টেম্বর। সনাতন শাস্ত্র মতে, সূর্য কন্যা রাশিতে প্রবেশ করলে পিতৃপক্ষ শুরু হয়।
লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, এই সময়  স্বর্গত পূর্বপুরুষরা পরলোক থেকে ইহলোকে তাদের উত্তরপুরুষদের গৃহে আসেন। তাদের তৃপ্ত করার জন্য তিল,জল দান করা হয়, এই রীতিকে তর্পণ বলা হয়। এরপর সূর্য বৃশ্চিক রাশিতে প্রবেশ করলে তাঁরা পুনরায় পরোলোকে ফিরে যান। হিন্দুধর্মানুসারে,মহালয়ার দিন পূর্বপুরুষদের যে তিল জল দান করা হয় সেই রীতিকে তর্পণ বলে।পিতৃপক্ষ পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্য পার্বণ শ্রাদ্ধ ও তর্পণ এর জন্য এক বিশেষ পক্ষ।




তর্পণ শব্দটির উৎপত্তি 'তৃপ' থেকে, যার মানে 'সন্তুষ্ট করা'। ঈশ্বর, ঋষি,পূর্বপুরুষদের আত্মার উদ্দেশ্য জল নিবেদন করে তাঁদের সন্তুষ্ট করাকেই তর্পণ বলে।শাস্ত্রমতে, যে কাজের মধ্যে দিয়ে  অপরের তৃপ্তি হয় সেটাই হলো তর্পণ। তর্পণের সময় ঈশ্বর, পূর্বপুরুষদের নাম উচ্চারণ করে তাঁদের কাছে সুখ শান্তি প্রার্থনা করা হয়।
পুরাণ অনুযায়ী, জীবিত ব্যক্তির তিন পুরুষ পর্যন্ত পিতৃলোকে বাস করে। এই পিতৃলোকের অবস্থান  স্বর্গ ও মর্ত্যের মাঝামাঝি জায়গায়। এই লোকের শাসক মৃত্যুর দেবতা যম। তিনিই মৃত ব্যক্তির আত্মাকে মর্ত্য থেকে পিতৃলোকে নিয়ে যান। পরবর্তী প্রজন্মের একজনের মৃত্যু হলে পূর্বপুরুষদের একজন পিতৃলোক ছেড়ে স্বর্গে গমন করেন এবং ঈশ্বরে লীন হয়ে যান। এই কারণে, জীবিত ব্যক্তির পূর্ববর্তী তিন প্রজন্মের শ্রাদ্ধানুষ্ঠান হয়ে থাকে।

হিন্দু ধর্মে,  কোনো মানুষ মারা গেলে তার পরিবার অশৌচ পালন করে নির্দিষ্ট দিনে ( কখনো ১১ দিন বা ১৩ দিন পরে) শ্রাদ্ধ করার নিয়ম। শ্রাদ্ধ হিন্দুধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ রীতি। মৃত্যুর পর মৃত মানুষের যথাযোগ্য নিয়ম মেনে শ্রাদ্ধ যদি না করা হয় তাহলে সেই মৃত মানুষের আত্মা মুক্তি পায় না। শুধু তাই নয়, এরপর মৃত মানুষের  মৃত্যুর তিথি মেনে প্রতি বছর শ্রাদ্ধ করতে হয় যাকে বাৎসরিক শ্রাদ্ধানুষ্ঠান বা পার্বণ শ্রাদ্ধ বলে। এই পিতৃপক্ষ হলো বংশের মৃত পূর্বপুরুষদের মুক্তির তিথি।
পিতৃপক্ষের শেষ দিন অর্থাৎ মহালয়ার দিন, তিথি মেনে পার্বণ শ্রাদ্ধ করতে যারা ভুলে যান তারা এই দিন শ্রাদ্ধ করতে পারেন। এই দিন  অনেকে গয়াতে গিয়ে শ্রাদ্ধ করেন।
মহালয়ার দিন নদী বা জলাশয়ে এই পার্বন শ্রাদ্ধ, তর্পণ করা হয়।

অনেক শাস্ত্রজ্ঞ মনে করেন, পারলৌকিক কাজকর্মের তিথি হিসেবে নির্দিষ্ট হওয়ার জন্য এই পিতৃপক্ষ শুভ না তাই এই সময় কোনো শুভ কাজ করা উচিৎ নয়।
তবে,  যে দিনে পরিচিত অপরিচিত সব প্রয়াতদের জল দান করে তাদের আত্মার শান্তির জন্য প্রার্থনা করা হয় সেই দিনকে অশুভ বলা কতটা যুক্তিযুক্ত?

মহালয়ার দিনে তর্পণ নিয়ে ভিন্ন মত আছে।
শাস্ত্র অনুযায়ী, দুর্গাপূজা হওয়ার নিয়ম বসন্তকালে। কিন্তু রামায়ণ অনুসারে, ত্রেতা যুগে লঙ্কা রাজ রাবণের সাথে যুদ্ধ জয়লাভ করে সীতাকে উদ্ধার করার জন্য অসময়ে শরৎকালে দেবী দুর্গার আরাধনা করেছিলেন। হিন্দু ধর্মে যেকোনো শুভ কাজ করার আগে প্রয়াত পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্য অঞ্জলি দেওয়ার রীতি আছে।রামচন্দ্র লঙ্কা জয় করার আগে সেই কাজটাই করেছিলেন এবং সেই তিথিটাই ছিলো মহালয়া। সেই থেকেই এই তর্পণ প্রথার প্রচলন হয়।
আবার মহাভারতে এর অন্য ব্যাখ্যা আছে। 

 

 

 

 


 



কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে মৃত্যুর পর কর্ণের আত্মা স্বর্গে গেলে সেখানে তাকে খাদ্য হিসাবে সোনা রত্ন দেওয়া হয়। অবাক হয়ে কর্ণ জানতে চান এইসব সোনা রত্ন কেনো তাকে খাওয়ার জন্য দেওয়া হচ্ছে?  উত্তরে দেবরাজ ইন্দ্র কর্ণকে বলেন, দানবীর বলে খ্যাত কর্ণ সারা জীবন ধরে সোনা, ধন-রত্ন দান করেছেন কিন্তু পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্য কখনো জল, খাদ্য দেয়নি তাই সেই কর্ম অনুযায়ী ফল হিসাবে সোনা, রত্ন এইসব খাদ্য রূপে তাকে দেওয়া হয়েছে। এই কথা শুনে কর্ণ জানান যে তিনি নিজের পূর্বপুরুষদের সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগের দিন কুন্তী এসে আমাকে জানান যে তিনি আমার মা,  তারপর সেই যুদ্ধে আমার মৃত্যু হয়। পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্য জল বা খাদ্য দেওয়ার সুযোগ হলো কোথায়?  এতে আমার দোষ কোথায়?  দেবরাজ ইন্দ্র বুঝতে পারলেন সত্যি কর্ণের কোনো দোষ নেই,  তাই তিনি কর্ণকে এক পক্ষকাল সময় দিয়ে মর্ত্যে ফেরত পাঠালেন যাতে কর্ণ পূর্বপুরুষদের জল, অন্ন দিতে পারেন। ইন্দ্রের কথা মতো কর্ণ এক পক্ষকাল মানে ১৫ দিন ধরে মর্ত্যে বাস করে পূর্বপুরুষদের জল অন্ন উৎসর্গ করে তাঁদের ঋণশোধ করে স্বর্গে ফিরে যান।
যে পক্ষকালে কর্ণ মর্ত্যে এসে পূর্বপুরুষদের জল, খাদ্য দিলেন সেই পক্ষটি পিতৃপক্ষ নামে পরিচিত আর এই জল অন্ন উৎসর্গ করাকেই তর্পণ বলে এবং সেই থেকেই এর প্রচলন হয়।

উপরের কাহিনী দুটি কতদূর সত্যি সেটা তর্কসাপেক্ষ। কিন্তু একটা বিষয় লক্ষ্য করার আছে এখানে, সেই বিষয়টি হলো পূর্বপুরুষদের জল খাদ্য উৎসর্গ করাটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আর এই ভাবনার উপরেই দাড়িয়ে আছে পিতৃপক্ষের আসল তাৎপর্য। আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছে ঋণী।পিতৃপক্ষ শ্রাদ্ধ মানে সোজা কথায় যাকে আমরা তর্পণ বলি সেই কাজটি করে আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের ঋণশোধের চেষ্টা করি। পরবর্তী প্রজন্মের কাছ থেকে খাদ্য জল গ্রহণ করে স্বর্গে পথে পাড়ি দেন পূর্বপুরুষেরা।
শাস্ত্রমতে,  পরিবারের পুরুষ সদস্যরাই তর্পণ করার অধিকারী। তবে এখন সময় পাল্টেছে, অনেক মহিলাকেও মহালয়ার দিনে গঙ্গা বা অন্যান্য নদী তীরে তর্পণে যোগদান করতে দেখা যায়।

দিন যতোই বদলে যাক, যুগ পাল্টে যাক তবু্ও এই দিনটির গুরুত্ব কমবে না বলেই ধরে নেওয়া যায়।
হিন্দু ধর্মে পিতৃপক্ষ পূর্বপুরুষদের  তর্পণের জন্য প্রশস্ত এক বিশেষ পক্ষ, যা মহালয়া নামে পরিচিত।

 শাস্ত্রে উল্লেখিত নিয়ম, রীতিনীতির বিশেষ ভূমিকা আছে। শাস্ত্রকারেরা শুধু শুধুই এতসব নিয়মের বেড়াজালে মানুষের জীবনকে বেধে দেননি,  এর বড় কারণ আছে। শাস্ত্র, ধর্ম নিয়ে নানান ছোটো বড় কথা বলে থাকেন অনেকে। তার মধ্যে ঠাট্টা বিদ্রুপের পরিমানই বেশী। কিন্তু একটু বুদ্ধি দিয়ে বিচার বিবেচনা করলে এইসব নিয়মের আসল উদ্দেশ্য বোঝা যাবে। যেমন  এই তর্পণ এর কথাই ধরা যাক, পূর্বপুরুষকে জল অন্ন উৎসর্গ করার নিয়ম। অনেকেই এর মধ্যে কোনো যুক্তি খুঁজে পায়না। সত্যি কি কোনো যুক্তি নেই???
আজকের নতুন প্রজন্মের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম, আমাদের আশেপাশে এমন অনেক বয়স্ক মানুষ আছেন যারা তাদের পূর্বপুরুষদের নাম ঠিকঠাক বলতে পারেন না। আমাদের আগের প্রজন্ম যদি নিজের বংশের পরলোকগত মানুষদের নাম না জানে তাহলে পরের প্রজন্মকে দোষ দিয়ে কি হবে?
শাস্ত্র, পুরান যাঁরা লিখেছেন তাঁরা ছিলেন এক একজন প্রকৃত অর্থে জ্ঞানী। শাস্ত্রকারের ভবিষ্যতের কথা ভেবেই শাস্ত্র রচনা করে এই ধরনের নানা নিয়মের প্রচলন করে গেছেন। আমি কোন বংশের, আমার পূর্বপুরুষ কারা ছিলেন, তাদের নাম কি এই সমস্ত তথ্য কি আমাদের জানা উচিৎ নয়?
এই কারণেই 'তর্পণ' এর প্রথার রীতি যুগ যুগ ধরে চলে আসছে।

সবশেষে বলি, ভবিষ্যতেও যাতে এই ধারা বজায় থাকে তার দায়িত্ব পরবর্তী প্রজন্মকে নিতে হবে। এই ভাবেই এক প্রজন্ম থেকে পরের প্রজন্মের হাত ধরে সনাতন হিন্দু ধর্মের অবশ্য পালনীয় শিক্ষনীয় ও মান্য রীতি নিয়মগুলো বেঁচে থাকবে।

 

 

copyright :   Rakasree Banerjee

creditor : internet 

মন্তব্যসমূহ

you may like

রামায়ণে বর্নিত পার্শ্বচরিত্রের প্রানীসমূহ আসলে কি ছিলো??? Relevancy of the non-human characters in RAMAYANA ....

Nepotism Is as old as Mahabharata !! মহাভারতও "Nepotism" দোষে দুষ্ট ( Mahabharata Stories )