মহাভারতের অবহেলিত চরিত্র সহদেব... The Neglected Sahadeva in Mahabharat..




 হিন্দু মহাকাব্য মহাভারত জুড়ে অনেক বীর মহারথীদের উল্লেখ আছে।  যথাঃ ভীষ্ম, পান্ডু, কৌরবগনদের মধ্যে বিশেষ ভাবে দুর্যোধন,  পান্ডবরা, দ্রোনাচার্য তাঁর পুত্র অশ্বথামা, বলরাম এরকম বহু powerful character আছে যাদের নিয়ে মহাভারতে অনেক কলমের কালি খরচ হয়েছে।  কিন্তু এমন কিছু চরিত্র আছেন যাঁদের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও খুব একটা জায়গা পায়নি।
অনেকটা হিন্দি সিনেমার side hero type, যোগ্যতা থেকেও hero হয়ে ওঠা হলোনা কোনোদিন।
মহাভারতেও ঠিক এমন একটি চরিত্র ছিলো যাঁর মধ্যে নায়ক হয়ে ওঠার সমস্ত meterial থাকেও supporting character হয়ে থেকে যেতে হলো সারা জীবন।
তিনি হলেন পঞ্চ পান্ডবের পঞ্চম পান্ডব  " সহদেব "
যুধিষ্ঠির,  ভীম, অর্জুন সম্পর্কে যার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা তাঁর অবস্থাটা সহনায়ক ছাড়া আর কি হতে পারতো?
আমার তো মনে হয়,  গোটা মহাভারত শুধু অর্জুনের বীরত্ব দেখানোর চেষ্টায় এমন অনেক বীর চরিত্রকে just over look করে গেছে।  তা না হলে সহদেবের যা গুন ছিলো সেটা নিয়ে আঠারো খন্ডের মহাকাব্যে খুব জোরালো ভাষায় তেমন কিছুই লেখা হয়নি।

আমার কেনো জানি না,বিভিন্ন পৌরাণিক কাব্য মাহাকাব্যের বহু আলোচিত চরিত্রগুলোর থেকে একটু off shade চরিত্রগুলো বেশী আর্কষণ করে।
তাই আজ আমি পঞ্চম পান্ডব সহদেবকে বেছে নিলাম।

পরিচিতিঃ 

 মহাভারত অনুযায়ী পান্ডুর পাঁচ পুত্রেরা হলেন পঞ্চপান্ডব।  এরা হলেন যথাক্রমে --- যুধিষ্ঠির,  ভীম, অর্জুন,  নকুল   সহদেব।  তার মনে পঞ্চম পান্ডব হলেন সহদেব।

জন্মঃ  

সহদেবের জন্ম হয় হস্তিনাপুর রাজ পান্ডুর দ্বিতীয় স্ত্রী মাদ্রীর গর্ভে,  এর জমজ আর এক ভাই হলেন নকুল।  পান্ডুর প্রথম স্ত্রী কুন্তীর পুত্রেরা হলেন যুধিষ্ঠির ভীম অর্জুন। এদের জন্ম বৃত্তান্ত সবারই জানা। কিন্দম ঋষি অভিশাপের জন্য পান্ডু নিজে কোনোদিন স্ত্রীদের সাথে মিলিত হতে পারেননি। কিন্তু সন্তানের আশা সমস্ত বিবাহিত নারী পুরুষ এর থাকে। পান্ডুরও ছিলো,  কিন্তু রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছিলেন কিন্দম। সন্তান কামনার কথা তিনি স্ত্রী কুন্তীকে জানান এবং তার সাথে কিন্দমের শাপের কথাও জানাতে ভোলেন না। কুন্তী দেখলো এই তো সুযোগ, কারন সন্তানহীন নারী হয়ে আজীবন থাকা পাপ তুল্য। তাই  তিনিও দূর্বাশার দ্বারা প্রাপ্ত বরদানের কথা বলেন  যার সাহায্য পুত্র লাভ হবে ( কুন্তীকে দূর্বাশার দেওয়া বরদান এর ঘটনা পাঠকরা নিশ্চয়ই জানেন,  তাই আর বিস্তারে গেলাম না) সব শুনে পান্ডু খুশিই হয়েছিলেন মনে হয় কারন এর পরেই স্বামীর অনুমতি নিয়ে কুন্তী তিন পুত্রের মাদ্রী দুই পুত্রের জননী হন।  এইসব পুত্রেরা ছিলেন এক একজন দেবতার ঔরসজাত সন্তান যাদের কুন্তী মাদ্রী নিজ গর্ভে ধারণ করেছিলেন। অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের দ্বারা মাদ্রীর গর্ভে যে দুই পুত্রের জন্ম হয় তারা হলেন নকুল সহদেব। এই হলো সহদেবের জন্মের তথ্য।
এরপর পান্ডু মারা গেলে,  মাদ্রী তার সাথে সহমরনে যান। তারমানে খুব ছোট বয়সেই সহদেব নকুল তাঁদের মাতা পিতাকে হারিয়েছিলেন। পান্ডুর প্রথম স্ত্রী কুন্তী নিজের তিন পুত্রের সাথে সতীনের দুই পুত্রকেও সন্তান স্নেহে বড় করেন।
এই হলো পঞ্চপান্ডব তথা সহদেবের জন্ম কথা।

এবার মুল কাহিনিতে ফেরা যাক,   
যে আজ আমার লেখার নায়ক সেই সহদেব ছিলেন  বুদ্ধিমান,  দূরদর্শীজ্ঞানসম্পন্ন অভিজ্ঞ একজন পুরুষ।
ভগবত পুরাণে আছে,  সহদেব ছিলেন কৃষ্ণের ভক্তদের মধ্যে অন্যতম। তাঁকে দৈত্যগুরু শুক্রাচার্যের অবতার মানা হয়। ভীষ্ম,  বিদূর ছাড়া একমাত্র সহদেব বুঝতে পেরেছিলেন কৃষ্ণ আর কেউ নন তিনি সর্বশক্তিমান ঈশ্বর। সেই সময়কার অনেক রাজা কৃষ্ণকে দেবতা রূপে পুজো করতে অগ্রহী ছিলেন না। এই সহদেবই প্রথম কৃষ্ণের পুজো করেন। শোনা যায়,  কৃষ্ণ নাকি একবার সহদেবকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ থামানোর কি উপায় আছে?   উত্তরে সহদেব বলেছিলেন আপনাকে বেঁধে রেখে মানে কৃষ্ণকে বেঁধে রেখে দুর্যোধনসহ সমস্ত কৌরব পান্ডবদের বনবাসে পাঠিয়ে দিয়ে কর্ণকে হস্তিনাপুর সিংহাসনে বসিয়ে দিয়ে যুদ্ধ থামানো যাবে। ভাবার বিষয় বৈকি... কতটা দূরদৃষ্টি থাকলে এমন উপায় মাথা থেকে বের হয়! 
কৃষ্ণকে বেঁধে রাখতে হবে মানে আটকাতে হবে কারন কৃষ্ণে এই যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র, তিনি থাকলে শুধু পাণ্ডবরা লাভবান হবেন তাই কৃষ্ণের থাকা চলবে না,  এরপর কৌরব পাণ্ডবদের বনবাসে পাঠিয়ে দিতে বলেছেন মানে কোনো পক্ষোই হস্তিনাপুরে না থাকলে সিংহাসন নিয়ে কাড়াকাড়িই হবে না, ঝামেলাই খতম আর কর্ণের মতো বীর যোদ্ধা মহাভারতে কতজন ছিলো? তাকে রাজা বানালে কুরুবংশের উন্নতি ছাড়া অবনতি হতো না। এতটা গভীরতা দিয়ে যেঁ ভাবতে পারে তাঁকে হালকাভাবে নেওয়াটা উচিৎ?  কৃষ্ণ কিন্তু সহদেবের উত্তরে খুশীই হয়েছিলেন।
মহাভারতে দ্রৌপদী এক জায়গায় বলছেন সহদেব ছিলেন সুপুরুষ, ভবিষ্যৎবক্তা প্রখর জ্যোতিষী,  যুদ্ধে পারদর্শী,তিনি আসিচালনায় ( তরবারি) অত্যন্ত সুদক্ষ ছিলেন। তাঁর তরবারির সামনে বহু বীর মহারথীরা দাঁড়াতে পারতেন না। এছাড়াও সহদেব ছিলেন  নৈতিকজ্ঞানসম্পন্ন জ্ঞানী। বহু জ্ঞানী পণ্ডিতেরা বুদ্ধি যুক্তিতর্কে তাঁর কাছে হার মানতো। তবে দ্রৌপদীর কথায় বোঝা যায়  সহদেব বেশ রাগী প্রকৃতির ছিলেন। এত গুনসম্পন্ন সহদেবকে আমরা কি আদৌও চিনি?


কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ সহদেবের ভূমিকাঃ

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ  part  ছিলো সহদেবের। ভালো জ্যোতিষী হওয়ার কারনে তিনি ভবিষ্যৎ বলতে পারতেন। কথিত আছে,  যুদ্ধ শুরুর আগে শকুনি দুর্যোধনকে পাঠিয়েছিলেন সহদেবের কাছ থেকে জেনে আসতে যে ঠিক কখন যুদ্ধ আরম্ভ করলে জয় কৌরবদেরই হবে। কৌরবরা শত্রুপক্ষ জেনেও সৎ সহদেব গননা করে সঠিক সময়টা বলে দেন। এই যুদ্ধে যদি কৃষ্ণের হস্তক্ষেপ না থাকতো, যদি ছল চাতুরীর আশ্রয় না নিয়ে যুদ্ধটা হতো তাহলে হয়তো কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ফলাফল অন্য হতো। সহদেবের কথাই ঠিক হতো। যুদ্ধে কি ঘটতে চলেছে সহদেব আগেই সেটা জানতেন কিন্তু তিনি চুপ থাকাটাই ঠিক মনে করেছিলেন।
এই যুদ্ধে একমাত্র সহদেব চেয়েছিলেন বিরাটকে পাণ্ডবদের  সেনাপতি করতে কারন সামরিক জ্ঞান প্রবল ছিলো। কিন্তু যুধিষ্ঠির অর্জুন ধৃষ্টদ্যুম্নকে সেনাপতি নিযুক্ত করেন। বুদ্ধিমান সহদেব জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাদের আড়ালে বারবার চাপা পড়ে গেছেন।
এই যুদ্ধে শত্রুপক্ষের অনেক বীর যোদ্ধাদের বীরত্বের সাথে হারিয়ে বধ করেছিলেন তিনি। পাশা খেলায় পরজয়ের জন্য স্ত্রী দ্রৌপদীর যে সম্মানহানি শকুনির প্ররোচনায় দুর্যোধনরা করেছিলেন,  সহদেব সেই সভায় দাড়িয়ে শকুনিকে নিজ হাতে হত্যা করার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। যুদ্ধের শেষদিন অর্থ্যাৎ আঠারোতম দিনে শকুনিকে হত্যা করে সেই প্রতিজ্ঞা পুরন করেন। এছাড়াও শকুনিপুত্র উলুকা ত্রিগত রাজকুমার নিরমিত্রকে তিনিই বধ করেন।

সহদেব পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে সব থেকে বেশী বুদ্ধিমান ছিলেন।  তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা যুধিষ্ঠির তাঁকে দেবগুরু বৃহস্পতির থেকেও বেশী বুদ্ধিমান বলেছেন।
কৌরবদের সুপরিকল্পিত পাশা খেলায় হেরে ( যার জন্য যুধিষ্ঠিরকে দায়ী করাই যায়)  বারো বছর বনবাস এক বছর অজ্ঞাতবাসে যেতে হয়েছিলো পাঁচ পাণ্ডব তাঁদের স্ত্রী দ্রৌপদীকে।  এই অজ্ঞাতবসের সময় তাঁরা বিরাট রাজ্যে লুকিয়ে ছিলেন এবং পঞ্চপাণ্ডবসহ দ্রৌপদী ছদ্মনাম ছদ্মবেশ ধারণ করেছিলেন। এইসময় সহদেব এক বৈশ্যের রূপ নেয়,  নাম হয় তান্তিপথ (মতান্তরে  অরিষ্টনেমি)। তিনি বিরাট রাজার গোশালা দেখাশোনার ভার নিয়েছিলেন। তবে বাকি ভ্রাতারা এই সময় সহদেবকে জয়দবল  বলে ডাকতেন।
 



বিবাহ সন্তানঃ

এটাতো সর্বজনবিদিত যে পঞ্চপাণ্ডব একসাথে  দ্রৌপদীকে বিবাহ করেন এবং সব ভাইদের ঔরসে দ্রৌপদীর একটি করে পুত্র সন্তান হয়। সহদেব দ্রৌপদীর পুত্র ছিলো শ্রুতসেন। এছাড়াও কথিত আছে সহদেব তাঁর মাসির মেয়ে মদ্র রাজকুমারী দ্যুতিমৎকে বিয়ে করেছিলেন এবং তাদের এক পুত্র জন্মায় যার নাম সুহোত্র।  পরে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কর্ণ সুহোত্রকে হত্যা করেন।
 

সহদেব এর রাজ্য জয় :

যুধিষ্ঠির যখন ইন্দ্রপ্রস্থ এর রাজা তখন তিনি সহদেবকে দাক্ষিণাত্যের রাজ্যগুলো জয় করার নির্দেশ দেন। কারন ভীষ্মের কথানুযায়ী সেই রাজ্যের রাজারা ছিলেন অসিযুদ্ধে দক্ষ আর সহদেবই ছিলেন যোগ্য সেই রাজাদের জন্য।
সহদেব দক্ষিণের অনেক রাজ্য জয় করেছিলেন, যেমনঃ শৌরসেন রাজ্য, মৎস্য রাজ্য, পান্ড্য রাজ্য, নিষাদ রাজ্য, কুন্তীভোজের রাজ্য, বেন্ব নদীর তীরবর্তী রাজ্য, অবন্তী রাজ্য, কোশল,  ত্রিপুরা, সৌরাষ্ট্র,  সুর্পরক রাজ্য, চরমনবতী অঞ্চল,  পৌরব, সমুদ্র উপকূলবর্তী ম্লেচ্ছ উপজাতি, কর্নপ্রবনক মনমুখ, দ্রাবিড়, কলিঙ্গ সহ আরও অনেক রাজ্য তিনি জয় করেন।  এই তালিকায় হয়তো তাঁর জয় করা অনেক রাজ্যের নাম বাদ গেলো।
সহদেব রাজ্যজয়ে বেরিয়ে যখন লঙ্কা রাজ্যে উপস্থিত হন তখন রাজা ছিলেন বিভীষণ। তিনি সহদেবকে বহু মূল্যবান উপহার দিয়েছিলেন।
কিষ্কিন্ধ্যা রাজ্যের রাজা মৈন্দ দৈবিদকে সাতদিন ধরে চলা যুদ্ধে পরাজিত করে তাদের রাজ্য জয় করেন।
ভাবা যায়!  এতগুলো রাজ্য সহদেব জয় করেছিলেন।  ক্ষমতা,  দক্ষতা, বুদ্ধি না থাকলে এটা সম্ভব?

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পরের ঘটনা যা জানা যায় তাতে যুধিষ্ঠির সহদেবকে তাঁর মামাবাড়ি মদ্ররাজ্যের রাজা নিযুক্ত করেন। এই সময় তাঁর জমজ ভ্রাতা নকুল সঙ্গে ছিলেন।

মৃত্যুঃ  

কলিযুগের আগমনের সময় যখন এলো এবং কৃষ্ণ দেহ রাখলেন তখন পাণ্ডবগণ তাঁদের বংশের একমাত্র জীবিত বংশধর পরীক্ষিতকে হস্তিনাপুর এর ভার সঁপে দিয়ে মহাপ্রস্থানের পথে হিমালয়ের দিকে যাত্রা করেন।  যাত্রাপথে দ্রৌপদী সবার প্রথম মারা যান আর তারপরেই সহদেব। ভীম যুধিষ্ঠিরকে সহদেব কেনো এত তারাতাড়ি মারা গেলো জিজ্ঞেস করেন।  উত্তরে যুধিষ্ঠির বলেন সহদেবের নাকি নিজের জ্ঞান নিয়ে অহংকার ছিলো সেটাই তাঁর মৃত্যুর কারণ।

সহদেব ছিলেন বিনয়ী,  লাজুক গুনী। তাঁর দক্ষতার জন্য তাঁকে মহারথী উপাধি দেওয়া হয়। যুদ্ধ পরিকল্পনাতে বিশেষ দক্ষ ছিলেন তিনি।

পাঠকগণের কি মনে হয়,  এতগুন থেকেও সহদেব কি খুব চর্চিত  চরিত্র ছিলো মহাভারতে?
তথ্যসূত্র : ইন্টারনেট 
copyright : Rakasree Banerjee

মন্তব্যসমূহ

you may like

রামায়ণে বর্নিত পার্শ্বচরিত্রের প্রানীসমূহ আসলে কি ছিলো??? Relevancy of the non-human characters in RAMAYANA ....

Nepotism Is as old as Mahabharata !! মহাভারতও "Nepotism" দোষে দুষ্ট ( Mahabharata Stories )

পিতৃপক্ষ ও কিছু কথা