বিষ্ণুর শঙ্খ চক্র গদা ও পদ্ম মানবজীবনে কি বার্তা দেয়? What Lord VISHNU'S Weapons Teaches Us?
ওমঃ নমোঃ ব্রাহ্মণ্য দেবায় গোঃ ব্রাহ্মণ্য হিতায়ঃ চঃ।
জগঃধিতায় কৃষ্ণায়ঃ গোবিন্দায়ঃ নমোঃ নমোঃ
এটি হলো ভগবান বিষ্ণুর ধ্যানমন্ত্র।যার অর্থ --- ব্রাহ্মণ্যদেবকে নমস্কার, গো- ব্রাহ্মণের হিতকারী এবং মঙ্গলকারী কৃষ্ণকে - গোবিন্দকে নমস্কার।
হিন্দু ধর্মের ত্রিমূর্তি দেবতাগন হলেন ব্রহ্মা - বিষ্ণু - মহেশ্বর। এঁনাদের মধ্যে বিষ্ণু হলেন বিশ্বের প্রতিপালক। হিন্দু ধর্মনুযায়ী বিষ্ণু বৈষ্ণবদের সর্বপ্রধান দেবতা। পুরাণে বিষ্ণুর বর্ননায় লেখা আছে, তাঁর গায়ের রং মেঘের মতো নীল, তিনি চতুর্ভুজ অর্থাৎ তাঁর চারটি হাত আর এই চার হাতে থাকে চারটি দ্রব্য। সেগুলো হলো শঙ্খ চক্র গদা ও পদ্ম। বিষ্ণুর ওপরের দিকের বাম ও ডান হস্তে থাকে যথাক্রমে শঙ্খ এবং চক্র। নিচের বাম ও ডান হস্তে থাকে যথাক্রমে গদা এবং পদ্ম।
ভগবান বিষ্ণুর এই রূপ সবার জানা। বিষ্ণুর চার হাতের এই শঙ্খ চক্র গদা ও পদ্ম শুধুই কি তাঁর সজ্জার অংশ নাকি এর উপস্থিতি কোনো গুরুত্বপূর্ণ দিক নির্দেশ করে?
উত্তর কিন্তু হ্যাঁ, ভগবান বিষ্ণুর এই শঙ্খ চক্র গদা ও পদ্ম সামাজিক জীব মানুষের জীবনের প্রতি মুহূর্তের চলার সঠিক পথ নির্দিষ্ট করে।
সেই দিকগুলো নিয়ে আজ আমি আলোচনা করবো।
হিন্দু ধর্মমতে, ভগবান বিষ্ণু সৃষ্টির শুরু থেকে শেষনাগের ওপর শায়িত, একে বিষ্ণুর "অনন্তশয্যা" বলা হয়।
" শান্তাকারম ভূজগশয়নং"
অর্থাৎ ভগবান বিষ্ণু শেষনাগের ওপর বিশ্রামররত।
বিশালাকৃতির সর্পের ওপর বিশ্রামরত বিষ্ণুকে দেখে প্রশ্ন জাগে তিনি কিভাবে এই ভয়ংকর সাপের ওপর সুখনিদ্রা দেন? হয়তো তিনি ভগবান বলেই তাঁর অলৌকিক ক্ষমতার জন্যই এই "শয্যায়" পরমসুখে নিদ্রামগ্ন। কিন্তু বিষ্ণুর এই শয্যারত রূপের সাথে মানবজীবনের সম্পর্ক আছে। ওই যে আগে বললাম শঙ্খ চক্র গদা ও পদ্ম এর কথা, ঠিক তেমনই।
শুধু ভগবান বিষ্ণু নয়, আমাদের আরাধ্য সমস্ত দেব-দেবীরা প্রত্যেকেই তাঁদের রূপ, সাজ-সজ্জা, কর্ম, অস্ত্র,বাহন প্রভৃতির দ্বারা মনুষ্যজাতিকে কিছু অর্থবহ ইঙ্গিত দিয়েছেন যা মানুষের বাস্তব জীবনে প্রতি মুহূর্তের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বার্তা।
প্রথমে বলি ভগবান বিষ্ণুর এই শয্যা নিয়ে। মানুষর্যপে জন্মানোর জন্য আমাদের অনেক দায়িত্ব কর্তব্যর মধ্যে দিয়ে জীবন বয়ে চলে। কিন্তু জীবনের চলার পথ সব সময় মসৃণ হয় না, সমাজে বসবাসকারী মানুষের বিভিন্ন প্রকার জটিলতা কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হয়। এই জটিলতাময় কঠিন অবস্থাকে শেষনাগের সাথে তুলনা করা হয়। বিষ্ণু শান্ত সৌম্য রূপের অধিকারী কিন্তু সময় বিশেষে তাঁর বিনাশকারী রূপের উল্লেখ পাই। মানুষকেও সমাজে থেকে নিজের দায়িত্ব কর্তব্য পালন করতে হবে এবং যে কোনো কঠিন পরিস্থিতিতে শান্ত হয়ে মোকাবিলা করতে হবে এবং প্রয়োজনে রুদ্র মূর্তি নিতে হবে।
এবার বিষ্ণুর চার হস্তের শঙ্খ চক্র গদা পদ্মের কথা বলবো----
বিষ্ণুর ওপরের বাম হস্তে থাকে শঙ্খ। যার নাম "পাঞ্চজন্য"। এই শঙ্খ এবং তার ধ্বনি সমগ্র পৃথিবীতে শ্রী বিষ্ণুর উপস্থিতি বোঝায়। তিনি সব জায়গায় বিরাজ করেন। প্রত্যেক প্রাণীতে, প্রত্যেক বস্তুতে, স্থলে -জলে - আকাশে সর্বত্র তিনি আছেন। এই কথা ঘোষণা করার জন্যই শঙ্খ প্রতীকী রূপে ব্যবহার হয়।
বিষ্ণুর ওপরের ডান হস্তে থাকে চক্র। বিষ্ণুর এই চক্রের নাম "সুদর্শন"। এই চক্র দ্বারা বিশ্বসংসারের প্রতিপালক বিষ্ণু যুগ যুগ ধরে অন্যায় অত্যাচারকে দমন করে আসছেন। পুরাণে আছে, সমগ্র বিশ্বকে রক্ষা করার জন্য বিষ্ণুর এমন একটি অস্ত্রের প্রয়োজন ছিলো যা হবে সমস্ত অস্ত্রের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। সেই সময় বিষ্ণু মহাদেবের শরনাপন্ন হন এবং তপস্যার দ্বারা মুগ্ধ করে মহাদেবের বরদান স্বরূপ এই সুদর্শন চক্র লাভ করেন। কথিত আছে এই চক্র খুবই শক্তিশালী ছিলো যার ভার বিষ্ণুর পক্ষে একা নেওয়া সম্ভব হলো না। তখন মহাদেব এই চক্রটিকে তিনটি ভাগে ভাগ করেন, যার একটি ভাগ দেন বিষ্ণুকে দ্বিতীয় ভাগটি দেন দেবী দুর্গাকে ও তৃতীয় ভাগটি রাখেন নিজের কাছে। এই চক্র একশত আটটি তীক্ষ্ণ ফলা বা ধার যুক্ত। সুদর্শন কথাটি সংস্কৃত ভাষা। " সু" কথার অর্থ ভালো বা মঙ্গল আর "দর্শন" কথার অর্থ দৃশ্যমান। অর্থাৎ সুদর্শন এর মানে হলো মঙ্গলময়দর্শন। আর চক্র শব্দের মানে যা চলাচল করতে সক্ষম।
বেদ ও পুরাণে দেব-দেবীদের যত অস্ত্রের উল্লেখ আছে তার মধ্যে এই সুদর্শন চক্রটি একমাত্র নিজে চলাচল করতে পারে।
এই হলো বিষ্ণুর সুদর্শন চক্র এর প্রাপ্তি ও তার বিবরণ। কিন্তু বিষ্ণুর হাতের এই চক্র মানব জীবনের কিসের প্রতীক?
চক্র বা চাকা বলতে চলাকে বোঝায়। বিষ্ণুর চক্র মানব জীবনের চলার প্রতীক। ঠিক যেমন পৃথিবীতে যা কিছুই হয়ে যাক,পৃথিবী নিজের গতিতে চলা বন্ধ করে না ঠিক সেই ভাবেই মানুষের জীবন চক্র যেভাবে চলছে সেই গতিতেই চলতে থাকে। আমাদের জীবন যেমন অতি প্রিয়জনের মৃত্যুতেও থেমে যায় না, আমরা আমাদের জীবনের গতি স্বাভাবিক রেখে এগিয়ে চলি সুদর্শন চক্র জীবনের সেই গতিকেই নির্দেশে করে। আদি অনন্ত কাল ধরে বিষ্ণুর এই চক্র ঘুরে চলছে বলে মনে করা হয়, এর মানে হলো পৃথিবীতে জীবনধারা নিজের পথে নিজের গতিতে সেই অতীত থেকে বর্তমান যুগেও চলছে এবং ভবিষ্যতেও চলবে।
বিষ্ণুর আর এক অস্ত্রে গদা, যা তাঁর নিচের বাম হস্তে থাকে। বিষ্ণুর এই গদার নাম " কৌমোদকী"। এই নামটির প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় মহাকাব্য মহাভারতে।যেখানে বিষ্ণুর অবতার রূপী কৃষ্ণের অস্ত্র হিসেবে কৌমোদকীর কথা আছে।
গদা হলো সবচেয়ে শক্তিশালী ও আদি অস্ত্র।
"দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন" বিষ্ণুর গদা তার প্রতীক। এর মানে মানুষকে ধর্মের পথে চলতে হবে, ন্যায়নীতি বোধ সজাগ রেখে সমাজে বাস করতে হবে। বিষ্ণুর হাতের গদা অধর্মের পথে চলা মানুষদের শাস্তির প্রতীক হিসেবে বোঝানো হয়েছে।
বিষ্ণুর নিচের ডান হস্তে থাকে পদ্ম, যা সৌন্দর্যের প্রতীক। সৎ থেকে ধর্মের পথে চলে জীবনের সব নিয়ম সুষ্ঠভাবে মেনে চলা মানুষদের উপহারের প্রতীক বিষ্ণুর পদ্ম। যার অর্থ ঈশ্বরকে লাভ করা।
শঙ্খ চক্র গদা ও পদ্ম ছাড়াও বিষ্ণুর মূর্তিতে ধনুক ও তরবারিও দেখা যায়। বিষ্ণুর ধনুকের নাম শার্ঙ্গ ও তরবারির নাম নন্দক।
বিষ্ণুর ধনুক শার্ঙ্গ এর উল্লেখ পাওয়া যায় রামায়ণ ও মহাভারত এই দুই মহাকাব্যে। শিবের হরধনু বা পিনাক তৈরীর সময় দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা শার্ঙ্গ তৈরী করেন। কথিত আছে, একবার শিব ব্রহ্মা ও বিষ্ণু এই তিনজনের মধ্যে কে উত্তম ধর্নুবীর জানার জন্য তাদের মধ্যে নকল এক যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধের ফলে সমগ্র বিশ্বের ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়। যুদ্ধরত অবস্থায় বিষ্ণু "হুং" মন্ত্র উচ্চারণ করেন, এতে মহাদেবের মনযোগ ছিন্ন হয় এবং তিনি হরধনু ত্যাগ করেন। এই সময় সব দেবতারা ব্রহ্মাকে যুদ্ধ শেষ করার অনুরোধ জানায় ও বিষ্ণুকে বিজয়ী বলে মেনে নিতে বলেন। সমস্ত ঘটনায় মহাদেব ভীষণ রেগে গিয়ে তাঁর হরধনু ছুড়ে ফেলে দেন। সেই হরধনু পৃথিবীতে পড়ে এবং রামায়ণে বর্ণিত মিথিলার রাজা জনকের পূর্বপুরুষ দেবরথ খুঁজে পান (পরবর্তীতে এই হরধনু ভঙ্গ করে রাম সীতাকে বিবাহ করেন)। মহাদেব হরধনু ত্যাগ করায় বিষ্ণুও তাঁর ধনুক শার্ঙ্গ ত্যাগ করবেন বলে মনস্থির করেন এবং ঋচীক মুনিকে দান করে দেন। এরপর বংশ পরম্পরায় এই ধনুক শার্ঙ্গ ঋচীক মুনির পৌত্র পরশুরামের হাতে আসে, যিনি ছিলেন বিষ্ণুর ষষ্ঠ অবতার।
মহাভারতে বিষ্ণুর অষ্টম অবতার কৃষ্ণের ধনুক হিসাবে শার্ঙ্গ এর উল্লেখ আছে।
এই হলো বিষ্ণুর অস্ত্র ও তার বিবরণ।
বিষ্ণুর এই শঙ্খ চক্র গদা পদ্ম শুধু তাঁর হাতের শোভাবর্ধন করার জন্য নয়, প্রত্যেকটির আলাদা গুরুত্ব আছে।
শুধু অন্ধের মতো ভগবানের নামগান করলে বা তাঁর নামে লোক ঠকিয়ে ব্যবসা করলেই ভগবানকে পাওয়া যায় না।
আমাদের শাস্ত্র, পুরাণ, বেদ উপনিষদের পাতায় পাতায় বর্নিত আছে নানান জ্ঞান, বিজ্ঞান, দর্শনের কথা। যা উপলব্ধি করতে হলে জানতে হবে আমাদের শাস্ত্রকে।
Creditor : INTERNET
COPYRIGHT : RAKASREE BANERJEE
Good information
উত্তরমুছুন