দেব দেবীদের বাহন মানব জীবনে কিসের প্রতীক ??? What the Careers of gods and goddesses symbolizes in human life ???



হিন্দু ধর্মের যত দেব-দেবীগণ আছেন তাদের প্রত্যেকের বাহন রূপে নানা জীব জন্তু পাখি দেখা যায়। বাহন মানে যে বহন করে। তারমানে প্রত্যেক দেব - দেবীদের যে বাহন আছে তারা এইসব দেবী দেবতাদের বহন করে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গমন করে। যাতায়াতের জন্য দেব - দেবীরা এই বাহনদের রাখেন।
কিন্তু একটু তলিয়ে ভাবলে এই ধারণার সত্যতা সম্পর্কে সন্দেহ জাগে। কারন,  প্রত্যেক দেব - দেবী নিজেরাই অনেক অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী, তাঁরা নিজেদের সেই ক্ষমতার জোরেই এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় বিনা বাধায় যাওয়া আসা করতে পারেন নিশ্চয়ই। তাহলে বাহন কেনো? কিছু কিছু দেব - দেবীর বাহন রূপে এমন প্রানী আছে যাদের শারিরীক ক্ষমতাই নেই কাঁধে বা পিঠে চাপিয়ে ঘুরে বেড়ানোর। যেমনঃ সিংহ হলো দেবী দুর্গার বাহন, সিংহ না হয় আকারে বড় শক্তিশালী প্রাণী। তার পক্ষে দুর্গাকে পিঠে নিয়ে যাতায়াত করাটা অসুবিধার নয় কিন্তু গনেশের বাহন ইঁদুর!! অমন গোলগাল চেহারার গনেশকে ছোট্ট একটা ইঁদুরের পক্ষে পিঠে নিয়ে ঘোরা সম্ভব?
এখানেই প্রশ্ন জাগে বিভিন্ন দেব-দেবীদের সাথে বাহন রূপে থাকা প্রাণীগুলোর অর্থ কি?
হিন্দু ধর্মের পূজার নিয়ম পদ্ধতিতে প্রকৃতি ও জীবের ব্যবহার সেই আদি যুগ থেকে প্রচলিত। এই সবই পুরাণের ঋষি মুনিদের বিজ্ঞান সম্পর্কে যে জ্ঞান ছিলো তার বহিঃপ্রকাশ। আধুনিক যুগ বিজ্ঞানের যুগ। আমরা নিজেদের আধুনিক বিজ্ঞানমস্ক বলে দাবি করি। কিন্তু এই বিজ্ঞান ও তার চর্চার আবিষ্কারক আধুনিক যুগ নয়।শাস্ত্র বেদ উপনিষদের রচয়িতাগণ প্রাচীন কালের মুনি ঋষিরা ছিলেন এক একজন বৈজ্ঞানিক এবং এটা প্রমাণিত। পুরাণ, শাস্ত্র, বেদের এতো অনুবাদ করা হয়েছে এবং কিছু তথাকথিত "পণ্ডিতবর্গের" হাতে পরে বিকৃতভাষ্য হয়েছে। যার ফলে সাধারণত মানুষ শাস্ত্র সম্পর্কে যা জেনে এসেছে তার অর্ধেকই ভুল। এইসব কারনের জন্যই এক শ্রেণীর "শিক্ষিত" মানুষ শাস্ত্র, দেব - দেবী সম্পর্কে ঠাট্টা বিদ্রুপ উপহাস করে নিজেদের আধুনিক প্রমান করেন। কিন্তু আসল শাস্ত্রজ্ঞান লাভ করা সহজ কম্ম নয়। শাস্ত্রে যা আছে তার দশ ভাগের এক ভাগও আধুনিক "পণ্ডিতরা" জানেন না।

যাই হোক, মূল কথায় ফেরা যাক----
দেব-দেবীদের সাথে যে বাহন থাকে এটা বাস্তুতন্ত্রের উদাহরণ। বিজ্ঞানের একটি শাখা বাস্তুতন্ত্র বা Ecosystem এবং  বিজ্ঞানের নানা চর্চা অতি প্রাচীন কাল থেকেই ছিলো। এর জন্য সমস্ত স্বীকৃতি প্রাচীন কালের মুনি ঋষিদের প্রাপ্য। শাস্ত্রে দেব দেবীদের বাহন দ্বারা এটাই বোঝানো হয়েছে যে প্রতিটি প্রানী পরিবেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তা না হলে পৃথিবীর ভারসাম্য ঠিক থাকবে না। যেমন মাংশাশী প্রানীরা হিংস্র বলেই তাদের মেরে ফেললে তৃনভোজী প্রানীর সংখ্যা বেড়ে যাবে এবং অরন্য, বনভূমির অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। বাস্তুতন্ত্রের খাদ্য খাদকের চেইনটি ( Chain) ঠিক রাখার জন্য মাংশাশী তৃনভোজী সব প্রকার প্রাণী প্রয়োজন। তাই কোনো কোনো দেব দেবীদের বাহন রূপে বাঘ সিংহ দেখা যায় এবং শাস্ত্রে এদের হত্যা করা নিষিদ্ধ। আবার কোনো কোনো দেবতা দেবীদের বাহন রূপে ইঁদুর, প্যাঁচা, ময়ূর, সাপ, হাঁস, গরু, ঈগল, হাতি ইত্যাদি প্রাণী দেখা যায়।
বাস্তুতন্ত্রে প্রত্যেক প্রাণী একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। এই প্রক্রিয়ার কোথাও কোনো বিঘ্ন ঘটলে প্রানীকূলের অস্তিত্ব সংকটে পরবে, সেই কথা ভেবেই প্রাচীন কাল থেকে মুনি ঋষিরা বিভিন্ন দেব-দেবীদের সাথে এইসব প্রাণীদের জুড়ে দিয়েছেন তাদের জীবন রক্ষা করার জন্য।
তাহলে এই কথা মেনে নিতে অসুবিধে নেই যে আমাদের পুরাণে বর্ণিত নিয়মগুলো বিজ্ঞানের ওপর ভর করেই তৈরী।
অন্যদিকে এইসব বাহনেরা জীবনের কিছু অর্থপূর্ণ দিকও নির্দেশ করে।







প্রথমে বলি দেবী দুর্গার বাহন সিংহের কথা---দেবী দুর্গা সিংবাহিনী। দুর্গা যদি সিংহের পিঠে চড়ে যাতায়াত করেন তাহলে শারদীয়া দুর্গা পূজার নিয়মাবলি, আগমন, গমন নিয়ে লেখা পুস্তকগুলোতে কেনো লেখা থাকে এই বছর মা দুর্গার গজে বা পালকিতে বা ঘোড়াতে বা নৌকায় আগমন গমনের কথা? মা দুর্গা এবার সিংহে আসছেন বা গমন করছেন এমন তো শোনা যায় না। এর প্রকৃত কারণ হলো সিংহ দুর্গার বাহন অর্থে যা বোঝায় তা নয়। তাহলে কেনো থাকে দুর্গার সাথে সিংহ? 
পদ্মপুরাণ অনুযায়ী, দেবী দুর্গার তেজ, ক্রোধ, শক্তির প্রতীক হিসেবে সিংহ তাঁর বাহন রূপে থাকে। পশুদের রাজা সিংহের শক্তি তেজ এর প্রকাশ অসুর নিধনে দেবী দুর্গার সেই রূপ দেখা যায়, যার দ্বারা দেবী অশুভের বিনাশ করেন।




আর এক দেবতা গনেশের বাহন ইঁদুর। গনেশকে সিদ্ধিদাতা বলা হয়। সিদ্ধি কথার অর্থ সফলতা। জগতের যে কোনো ব্যক্তিকে সফল হতে হলে নানা ধরনের বাধা বিপত্তি, ষড়যন্ত্রের জাল কেটে এগিয়ে যেতে হয়। সাফল্যের রাস্তায় বাধা আসবেই। কিন্তু এই বাধাগ্রস্ত পথে ধৈর্য ও মনের জোড়কে অবলম্বন করে যে এগিয়ে যেতে সক্ষম হয় সেই সাফল্য লাভ করে অর্থাৎ  সিদ্ধি পায়। ঠিক যেমন ইঁদুরকে জালে আটকে রাখলে সে তার তীক্ষ্ণ দাঁতের সাহায্যে সেই জাল কেটে মুক্তি লাভ করে। সিদ্ধিদাতা গনেশের বাহন রূপে ইঁদুর মানুষকে এই বার্তা দেয় সফলতার রাস্তায় অশুভ শক্তির যতই জাল বিছানো থাক তার থেকে মুক্তির পথ ধৈর্য সহকারে খুঁজে নিতে হবে। তবেই সিদ্ধি লাভ হবে।
তাহলে গনেশ যে ইঁদুরের পিঠে চড়ে ঘুরে বেড়ায় না এটা আশা করি বোঝা গেলো।




এবার কার্তিক এর বাহন ময়ূর এর কথা বলবো  ---
দেবতা কার্তিকের বাহন ময়ূর এবং ময়ূরের পায়ের নিচে চেপে ধরা থাকে সাপ। কার্তিক হলেন যুবা যোদ্ধা ও সৌন্দর্যে ভরপুর এক দেবতা। ময়ূর কার্তিকের এই গুন গুলোর বার্তা দেয়। কার্তিক চির যুবক, ময়ূরও তেমনই মৃত্যু পর্যন্ত সুন্দর থাকে। সব পাখিদের মধ্যে যোদ্ধা হিসেবে ময়ূরের পরিচিতি আছে, অপরদিকে কার্তিকও ভালো যোদ্ধা। তিনি দেবতাদের সেনাপতি। ময়ূরের পায়ে চাপা সাপটি হলো গোপন ষড়যন্ত্রের প্রতীক। যে কোনো যুদ্ধ মানেই ষড়যন্ত্র থাকবেই, ময়ূরের পায়ের নিচের সাপটির অর্থ হলো গোপন শত্রুকে নাশ করার প্রতীক। শুধু যুদ্ধে পারদর্শী হলেই হবে না, যুদ্ধের গোপন ষড়যন্ত্রকে দমন করার কৌশলও জানতে হবে। কার্তিকের বাহন ময়ূর ও তার পায়ে চেপে রাখা সাপ সেই বার্তাই দেয়।




দেবী সরস্বতীর বাহন রাজহাঁস। দুধ ও জল মিশিয়ে দিলে রাজহাঁস শুধু দুধটুকু খাওয়ার ক্ষমতা রাখে। বিদ্যার দেবী সরস্বতীর বাহন রূপে রাজহাঁস সমাজে বিশেষ করে বিদ্যার্থীদের এই বার্তা দেয় যে সমাজে ভালো মন্দ সব ধরনের জ্ঞান বর্তমান, তার মধ্যে থেকে ভালো জ্ঞান অর্জন করাই শ্রেষ্ঠ বিদ্যার্থীর পরম লক্ষ্য। সরস্বতীর বাহন শ্বেতশুভ্র রাজহাঁস। সাদা সততার প্রতীক। প্রত্যেক মানুষকে নিজেদের জীবনের অন্ধকার দিকগুলো কাটিয়ে সততা পথে চলার ইঙ্গিত দেয় বিদ্যার দেবীর বাহন রাজহাঁস।





দেবী লক্ষ্মীর বাহন প্যাঁচা, যাকে লক্ষ্মী প্যাঁচা বলে। প্যাঁচাদের একটি বৈশিষ্ট্য হলো  রাতের অন্ধকারে এদের দৃষ্টি পরিষ্কার। মানবজীবনে ঘোরতর সংকট বোঝাতে অন্ধকার শব্দটি ব্যবহার করা হয়। এই অন্ধকার মানে অশুভ বা বিপদের আভাস। ধন সম্পদের দেবী লক্ষ্মীর বাহন প্যাঁচা আমাদের আসন্ন বিপদের থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার বার্তা দেয়। ধন সম্পদ টাকা পয়সা থাকলে বিপদ থাকবেই।কিন্তু বিপদ যতই বড় হোক বা কঠিন, রাতের অন্ধকার ভেদ করে প্যাঁচা যেমন তার লক্ষ্য ঠিক রাখতে পারে তেমনই বিপদে মানুষকে নিজের লক্ষ্যে দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে সঠিক পথ খুঁজে নিতে হবে নিজের ধন - সম্পত্তি রক্ষা করার। প্যাঁচার আরও একটি বৈশিষ্ট্য হলো নিজেকে গোপন রাখা। দিনের আলোতে সে নিজেকে লুকিয়ে রাখে। মানুষকেও ঠিক সেইভাবে নিজের অর্জিত ধন সম্পদ গোপনে রাখতে হবে। পাঁচজনের মাঝে নিজের টাকা পয়সার গল্প করা মানেই নিজের বিপদ ডেকে আনা, সমস্যা বাড়ানো ছাড়া আর কিছু না। প্রত্যেক মানুষকে নিজের ধন সম্পদ গোপন রাখার শিক্ষা দেয় ধন সম্পদের দেবী লক্ষ্মীর বাহন প্যাঁচা।

দেবাদিদেব মহাদেবের বাহন নন্দী নামের ষাঁড়। সনাতন ধর্ম মতে, শিব হলেন ধ্বংসের দেবতা। আসলে ঈশ্বরের ধ্বংসাত্মক রূপের নাম শিব। বিশ্ব সংসারের সৃষ্টি ও তার রক্ষার জন্য মহাদেবকে ধ্বংসের রূপ নিতে হয়। শিবের সাথে বাহন রূপে ষাঁড় থাকার কারণ, ধ্বংসকারীকে হতে হবে জেদি একগুঁয়ে এবং অবশ্যই শক্তিশালী( ধ্বংস বলতে এখানে অশুভ শক্তির বিনাশ বোঝানো হয়েছে) । ঠিক যেমন  ষাঁড়ের একগুঁয়ে ধ্বংসাত্মক স্বভাব এবং এতোটাই শক্তি যে মূহুর্তের মধ্যে শেষ করে দিতে পারে আস্ত একটা জনবসতিকে।
শিবের সাথে থাকা বাহনরূপী ষাঁড় শিবের তাণ্ডব রূপের প্রতীক।

আশা করি, দেব দেবীদের বাহন রূপে যেসব প্রাণীদের দেখা যায় তাদের উপস্থিতির কারন কিছুটা হলেও জানাতে সক্ষম হয়েছি। এরপর থেকে কোনো দেব-দেবীর মূর্তি বাহনের সাথে দেখলে একদম ভাববেন না যে ওইসব প্রানীগুলোর পিঠে বা কাঁধে চড়ে ওঁনারা ঘুরে বেড়ায়।




Creditor : Internet
Copyright : Rakasree Banerjee

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Please do not enter any spam link in comment box

you may like

রামায়ণে বর্নিত পার্শ্বচরিত্রের প্রানীসমূহ আসলে কি ছিলো??? Relevancy of the non-human characters in RAMAYANA ....

Nepotism Is as old as Mahabharata !! মহাভারতও "Nepotism" দোষে দুষ্ট ( Mahabharata Stories )

পিতৃপক্ষ ও কিছু কথা