যুধিষ্ঠির কতটা ধর্মপরায়ণ? How pious is Yudhisthira??? ( Mahabharata stories )





পাণ্ডুর পাঁচ পুত্র পঞ্চপাণ্ডবদের ও ধৃতরাষ্ট্র এর একশত পুত্র কৌরবদের জীবনের নানান টানাপোড়েন, কূটনৈতিক রাজনৈতিক দন্দ্ব, সিংহাসনের অধিকারের লড়াই,স্বজন বিরোধিতা, যুদ্ধ এইসব নিয়েই হিন্দুদের এই মহাকাব্য মহাভারতের কাহিনির বিন্যাস ঘটেছে।
এই মহাকাব্যের ঘটনাসমূহ জানেন না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুস্কর।  

এই মহাকাব্য এত চরিত্রের সমাবেশ যাদের মধ্যে কেউ সৎচরিত্রের আবার কেউ কপট চরিত্রের এবং তাঁদের শৌর্য, মহত্ত্ব,গুণের, বুদ্ধিমত্তার সাথে সাথে লোভ হিংসা, রাজনৈতিক কূটনৈতিক বুদ্ধিতে ভরপুর ছিলো এই সব চরিত্ররা।

মহাভারতের এমনই এক চরিত্র যুধিষ্ঠির। যিনি ধর্মপুত্র নামেও খ্যাত ছিলেন। তিনি সত্যের প্রতীক।

মহাভারত অনুযায়ী পাণ্ডুর পাঁচ পুত্রের জ্যেষ্ঠ ছিলেন যুধিষ্ঠির। কিন্দম মুনির অভিশাপের জন্য পাণ্ডু তার দুই স্ত্রী কুন্তী ও মাদ্রীর সাথে মিলনে অক্ষম ছিলেন, এবং পাণ্ডুর স্ত্রী কুন্তী ছিলেন দূর্বাশার বরপ্রাপ্ত যে বরদানের সাহায্যে  কুন্তী যে কোনো দেবতাকে আহ্বান জানিয়ে সেই দেবতার দ্বারা সন্তান জন্ম দিতে সক্ষম। পাণ্ডুর অক্ষমতার জন্য পাণ্ডুর কথাতেই কুন্তী তিন দেবতার সাথে মিলিত হয়ে তিন পুত্র সন্তানের জন্ম দেন।এই তিন দেবতারা হলেন ধর্মরাজ, দেবরাজ ইন্দ্র ও পবনদেব। পরে মাদ্রীও কুন্তীর এই বরদানের সাহায্যে দুই দেবতা আশ্বিনীকুমারদ্বয়ের থেকে দুই পুত্রকে জন্ম দেয়। পাণ্ডুর এই পাঁচ পুত্রকে মহাভারতে পঞ্চপাণ্ডব নামে আখ্যায়িত করা হয়। এই পাঁচ পুত্রের মধ্যে সর্বপ্রথম জন্ম হয় শতপর্বত শৃঙ্গে ধর্মরাজের সাথে কুন্তীর মিলনে যুধিষ্ঠিরের, এরপর পবনদেবের দ্বারা ভীম ও ইন্দ্রের দ্বারা জন্ম হয় অর্জুনের। এছাড়া মাদ্রীর গর্ভে অশ্বিনীকুমারদের দ্বারা দুই পুত্রের জন্ম হয় তারা হলেন নকুল ও সহদেব।
মহাভারত মতে, ইন্দ্র ধৈবত চন্দ্র সংযুক্ত  অভিজিৎ নামক নক্ষত্রে অষ্টম মুহূর্তে মধ্যাহ্ন সময়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন যুধিষ্ঠির। অস্ত্রগুরু দ্রোনাচার্যের কাছে যুধিষ্ঠির ও বাকি চার পাণ্ডব অস্ত্রশিক্ষা লাভ করে। যুধিষ্ঠির ছিলেন বর্শা যুদ্ধে বিশেষ পারদর্শী। এছাড়াও তিনি রথ চালনায় দক্ষ ছিলেন। পাঞ্চাল রাজ দ্রুপদের কন্যা দ্রৌপদী ছিলেন পঞ্চপাণ্ডবদের স্ত্রী।দ্রৌপদী পঞ্চপাণ্ডব দ্বারা পাঁচ পুত্রের জন্ম দিয়েছিলেন। যুধিষ্ঠিরও দ্রৌপদীর পুত্রের নাম ছিলো প্রতিবিন্ধ্য।যুধিষ্ঠিরের আরও একজন স্ত্রী ছিলো। গোবাসনের কন্যা দেবিকাকে স্বয়ংবর সভায় জিতে বিবাহ করেছিলেন যুধিষ্ঠির এবং দেবিকা ও যুধিষ্ঠিরের  বৌধেয় নামে এক পুত্র সন্তান ছিলো।

 সততা, সত্যবাদীতা, অহিংসা স্থিরবুদ্ধিসম্পন্ন,ধৈর্যশীলতা ছিলো যুধিষ্ঠিরের চরিত্রের প্রধান দিক। ধর্ম সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান ছিলো অপার। গোটা মহাভারত জুড়ে তাঁর গুনগান। পাপী অপরাধীকে ক্ষমা করা ছিলো তার চরিত্রের অন্যতম দিক। ভাইদের প্রতি তিনি ছিলেন স্নেহশীল। কিন্তু যুধিষ্ঠিরের চরিত্রের এই দিকগুলো একেক সময় অসহ্যকর হয়ে উঠেছিল তাঁর ভাইদের বা তাঁর স্ত্রী এর জন্য। নিজের মা কুন্তী উদযোগপর্বে যুধিষ্ঠিরকে বলেছিলেন " পুত্র তুমি মন্দমতি, শ্রোত্রিয় ব্রাহ্মণের ন্যায় কেবল শাস্ত্র আলোচনা করে তোমার বুদ্ধি বিকৃত হয়েছে, তুমি শুধু ধর্মেরই চিন্তা করেছ" ( কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাস কৃত মহাভারত)।
 যুধিষ্ঠিরের এই ভালোমানুষী রূপের আড়ালে তাঁর ধর্মভীরু রূপটা বড় বেশী প্রকাশ পেয়ে গেছে কোনো কোনো ক্ষেত্রে।  সব সময় পাপ পূন্যের সুক্ষ বিচার  করতে গিয়ে নিজের চরিত্রের ভারসাম্য হারিয়েছেন বলেই মনে হয়। যুধিষ্ঠিরের অহংবুদ্ধি একটু বেশী ছিলো, সে নিজেকে পাপী বলে দুঃখপ্রকাশ করতেন, এইসব কারনে ভীম ও দ্রৌপদী তাকে বহু ভৎসনা করেছে। ক্ষত্রিয়  যুধিষ্ঠিরের মুখে বার বার বৈরাগ্যর কথা শুনে  মহাভারত রচয়িতা ব্যাসদেবও বিরক্ত হয়েছেন।
যুধিষ্ঠির নিজের সততা সত্যবাদীতা রক্ষার একগুঁয়েমির জন্য চার ভাই ও স্ত্রী দ্রৌপদীকে অপমান লাঞ্ছনা উপহার দিয়েছেন যা এই মহাকাব্যের সভাপর্বে দেখা যায়। যেখানে শকুনির প্ররোচনায় দুর্যোধন সহ বাকি কৌরবগণ পাণ্ডবদের দ্যুত ক্রীড়ায় ( পাশা খেলা) আমন্ত্রন জানায়। ইন্দ্রপ্রস্থে পাণ্ডবগণের ধন সম্পদ, প্রভাব প্রতিপত্তি দেখে ঈর্ষায় বশীভূত হয়ে মামা শকুনিকে দূর্যোধন জানায় তিনি পাণ্ডবদের সমস্ত ধন সম্পদের মালিক হতে চায়, যা তার পক্ষে যুদ্ধ দ্বারা জয় করা সম্ভব নয়। শকুনি দূর্যোধনকে জানায় যুধিষ্ঠির দ্যুত ক্রীড়া  ভালোবাসে কিন্তু খেলতে জানে না, যুধিষ্ঠিরকে খেলায় আহ্বান জানালে সে না করবে না। এই খেলায় শকুনির মতো পারদর্শী ত্রিলোকে কেউ ছিলো না। সেই মতো দূর্যোধন পাণ্ডবদের আমন্ত্রণ জানায় যাতে ছলের সাহায্যে  তাদের সম্পত্তি হরন করতে পারে।
যুধিষ্ঠির আমন্ত্রণ রক্ষার জন্য দ্রৌপদীসহ চার ভাই ও পরিজনদের নিয়ে হস্তিনাপুরে আসেন। দ্যুতসভায় চার ভাইকে নিয়ে হাজির হন যুধিষ্ঠির। খেলা শুরুর আগে ঠিক হয় পাণ্ডবদের পক্ষে যুধিষ্ঠির ও কৌরবদের পক্ষে শকুনি এই খেলায় অংশ নেবেন। খেলার নিয়মানুসারে কিছু জিনিস পন রাখতে হয়। যুধিষ্ঠির প্রথমে নিজের স্বর্নহারের বহুমূল্য রত্ন থেকে একে একে তাঁর দাসদাসী, বীর সৈন্য সব পন রেখে খেলে হারলেন। শকুনি ও দূর্যোধন এর পরেও খেলা চালিয়ে যেতে বলেন। যুধিষ্ঠির আত্ম অহংকারে মত্ত হয়ে বলেন আমার ধন সম্পদের পরিমাণ বিপুল, আমি সেইসব পন রেখে খেলবো। তিনি অসংখ্য উত্তম অশ্ব,হস্তি,গরু,ছাগল, মেষ ও সিন্ধু নদীর পূর্বপারের সমস্ত সম্পত্তি,নগর, জনপদ, ব্রহ্মস্ব বাদে সমস্ত ধন, জমি, ব্রাহ্মণ বাদে সমস্ত পুরুষ পন রাখলেন এবং এবারো তিনি শকুনির কাছে হারলেন। এরপর যুধিষ্ঠির নিজের ও ভাইদের দেহের অলঙ্কার পন রেখে খেলে হারলেন। এই পর্যন্ত তিনি যা যা পন রেখে খেলে হারলেন তার সব কিছুর অধিকার পাঁচ পাণ্ডববের সমান ছিলো, অর্জুনের অস্ত্রপ্রভাবের ফলেই যুধিষ্ঠিরের অধিকারে এসেছিলো অনেক রাজ্য রাজা এবং ধন সম্পদ। রাজসূয় যজ্ঞ সুসম্পন্ন করতে পেরেছিলেন অর্জুন, ভীম, নকুল ও সহদেবের সহযোগিতায়।সেই সমস্ত সম্পদের পন রেখে যুধিষ্ঠির দ্যুত ক্রীড়ায় সব হারালেন। ভাইয়েরা তাঁর অনুগত ছিলো, হয়তো তাই চার পাণ্ডব জ্যেষ্ঠ ভাইয়ের এই কাজে বাধা দেননি।
এখানেই যদি যুধিষ্ঠির খেলা শেষ করে নিজের হার স্বীকার করে নিতেন তাহলে তাকে কিছুটা অনুকম্পা করা যেতো। কারন বিরোধী পক্ষ কি চাইছে সেটা বোঝার মতো জ্ঞান যুধিষ্ঠিরের ছিলো নিশ্চয়ই। কিন্তু এরপর তিনি যা করলেন সেই কাজ তাঁর মতো ধর্মপরায়ণ মানুষের কাছে আশা করা যায় না। দ্যুত ক্রীড়ায় পন হিসেবে তিনি নিজের ছোটো ভাই নকুল ও সহদেবকে রাখলেন। যে বস্তু পন রাখা হয় তার সম্পর্কে বর্ননা দেওয়ার নিয়ম হেতু যুধিষ্ঠির বললেন "শ্যামবর্ণ লোহিতাক্ষ সিংহস্কন্ধ মহাবাহু যুবা নকুল আমার পন"। নকুলকে দান ফেলে জিতে নেয় শকুনি ও পরের দানে সহদেবকেও। শকুনি বলেন, "যুধিষ্ঠির আপনার প্রিয়  মাদ্রীপুত্রদের জিতেছি, ভীম ও অর্জুন বোধহয় আপনার  আরও প্রিয় তাই তাদের এখনও পন রাখলেননা"... উত্তরে যুধিষ্ঠির বললেন "আমাদের ভাইদের মধ্যে ভেদাভেদ জন্মাতে চাইছেন, এবার আমি অর্জুনকে পন রাখছি"....
অর্জুনকে পন রাখার সময় তার সম্পর্কে যুধিষ্ঠির বলেন  "যিনি যুদ্ধে নৌকার মতো আমাদের পার করে,যিনি শত্রুজয়ী ও বলিষ্ঠ,  যিনি সব্যসাচী সমান দক্ষতায় দুই হাতে তীর চালাতে পারে সেই পনের অযোগ্য রাজপুত্র অর্জুনকে পন রাখছি"। প্রতিবারের মতো এবারও দান ফেলে শকুনি অর্জুনকেও জিতে নেয়। এবার পালা ভীমের, যুধিষ্ঠির ভীমের বর্ননায় বলেন, "বজ্রধারী ইন্দ্রের ন্যায় যুদ্ধে আমাদের নেতা,যিনি তির্যকপ্রের্ক্ষী, সিংহস্কন্ধ ,ক্রুদ্ধ স্বভাব, যার তুল্য বলবান কেউ নেই সেই ভীমকে পন রাখছি"। বলাবাহুল্য ভীমকেও শকুনি জিতে নেয়।
এই জিতে নেওয়ার অর্থ হলো, যুধিষ্ঠির পন রেখে যে যে বস্তু ও প্রানীদের( হাতি, ঘোড়া,গরু, মেষ,ছাগল, দাসদাসী, সৈন্য, এবং নিজের চার ভাই) হারলেন সেই সব কিছু কৌরবদের অধিকারভুক্ত হলো। তারমানে অর্জুন, ভীম, নকুল ও সহদেব কৌরবদের দাসে পরিনত হলো। ভাবা যায়!!!! যে খেলার শুরু থেকেই ছল কপটতা স্পষ্ট ছিলো, যে কোনো সাধারণ মানুষের পক্ষে তা বোঝা সম্ভব, অতি জ্ঞানী যুধিষ্ঠির সেটা বুঝতে পারলেন না????  ধন সম্পদ পর্যন্ত তাও মেনে নেওয়া যায় কিন্তু দাসদাসী থেকে শুরু করে সৈন্য ( যারা সংখ্যায় ছিলো লক্ষাধিক) শেষে নিজের ভাইদের পন রাখলেন যুধিষ্ঠির???  ধর্মপরায়ণ সত্যবাদী যুধিষ্ঠির, আস্ত মানুষগুলোকে পন রেখে খেলা চালিয়ে যাওয়ার মধ্যে কোন ধর্ম কোন সত্যতা রক্ষা করেছিলেন??? যে খেলায় একের পর এক সব হারিয়ে নিজের ভাইদের দাসে পরিনত করে সেই খেলায় আর যাই থাক ধর্ম থাকে না।
চার ভাইয়ের পর তিনি নিজেকেই পন রাখলেন ও হারলেন। কিন্তু খেলা এখানেই শেষ হয়না, শকুনি ছেড়ে দেওয়ার পাত্র না, তিনি যুধিষ্ঠিরকে বললেন, "কোনো ধন বা বস্তু অবশিষ্ট থাকতে কেনো নিজেকে পন রেখে হারলেন, এতে পাপ হয়। পাঞ্চালী এখনও বাকি আছে,তাকে পন রেখে নিজেকে মুক্ত করুন"। এই কথা শোনার পরে, যেখানে নিজের স্ত্রীকে পন রাখার জন্য বলা হচ্ছে যে কোনো পুরুষ ( যদি সত্যিকারের পুরুষ হয়ে থাকে ) প্রবল আপত্তি ও বিরোধিতা করবে সেটাই কাম্য। কিন্তু মহান সত্যবাদী ধার্মিক যুধিষ্ঠির পন করে বসলেন দ্রৌপদীকে, যে দ্রৌপদী তার একার স্ত্রী ছিলেন না, যে দ্রৌপদী কোনো সামগ্রী ছিলোনা। পাঞ্চাল রাজকন্যা, হস্তিনাপুরের  রাজকুলবধু দ্রৌপদীকে পন রাখার অধিকার কি আদৌও যুধিষ্ঠিরের ছিলো? বিয়ে করা বউ মানেই সে পরাধীন, তার ইচ্ছা অনিচ্ছা থাকবেনা, স্বামী হয়ে তিনি যা বলবেন তাই করতে বাধ্য, এটা ভেবে নিয়েই কি যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীকে ভরাসভায় পন রেখেছিলেন?  নিশ্চয়ই তাই হবে না হলে তিনি একবার দ্রৌপদীকে জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজনবোধ করেননি কেনো এতবড় একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে?
যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীকে শুধু পন রাখলেন তাই না, তার বর্ননায় বললেন " যিনি নাতিহ্রস্বা,নাতিদীর্ঘা,নাতিকৃশা ও নাতিস্থূল, কুঞ্চিত কেশী, পদ্মপলশাক্ষী, পদ্মগন্ধা, ভর্ত্তার অভিলাষিত সর্বগুনাম্বিতা, যাহার সস্বেদ মুখপঙ্কজ মল্লিকার ন্যায় ( এর অর্থ ঘামলে কেমন অপরূপ দেখায় তাকে), মধ্যদেশ বেদীর ন্যায় সেই সর্বাঙ্গসুন্দরী দ্রৌপদীকে পন রাখলাম"।
এর আগে ভাইদের যখন পন রাখলেন যুধিষ্ঠির তখন তাদের গুনের কথাই শুধু বলেছিলেন কিন্তু দ্রৌপদীর বেলায় তার শারীরিক সৌন্দর্যের বর্ননা ছাড়া আর কিছুই নেই!!! চুল কেমন কত উচ্চতা, দেহ গঠন, রোগা না মোটা সব বলে দিলেন!!!
যে ভরনপোষণ করে সেই ভর্ত্তা বা স্বামী যা যা গুন চায় স্ত্রীর মধ্যে সেই সব গুন দ্রৌপদীর আছে সেটাও বলতে দ্বিধা বোধ করলেন না যুধিষ্ঠির। ঘামলে কেমন সুন্দরী দেখায় দ্রৌপদীকে সেই কথাও বর্ননাতে দিতে হলো?
যে সভায় চারিদিকে শুধুই পুরুষ এবং সম্পর্কে যারা দ্রৌপদীর শ্বশুর স্থানীয় কেউবা দেওর, অন্যান্য আরও পুরুষ যারা দ্রৌপদীর বিবাহসূত্রে আত্মীয় সেই সমস্ত পুরুষদের সামনে বংশের বধূকে এমন উপমায় আখ্যায়িত করা ধর্মাত্মা যুধিষ্ঠিরের উচিৎ ছিলো কি? পাশা খেলায় নিজের অহংবোধে মত্ত যুধিষ্ঠিরকে অধিকারপরায়ন স্বামী ছাড়া আর অন্য কিছু ভাবা যায় না।কারন যে পুরুষ নিজের স্ত্রীকে শুধু ভোগবিলাসের বস্তু মনে করে না বন্ধু ভাবে সেই পুরুষ জানেন নিজের স্ত্রী কেনো, কোনো মেয়েকেই জনসমক্ষে এইভাবে তুলে ধরা যায় না। তাছাড়া, আগেই যেখানে নিজেই নিজেকে পন রেখে হেরে গিয়েছিলেন সেই হেরে যাওয়া দাস যুধিষ্ঠির কি করে দ্রৌপদীকে পন রাখেন? সেই অধিকার তার ছিলো না।
দ্রৌপদীকে পন রেখে যথারীতি যুধিষ্ঠির হারলেন এবং তার বর্ননা শুনে কর্ণ -দুঃশাসন- দুর্যোধনরা এই সময়েরই অপেক্ষা করছিলেন। ব্যাস আর কি, আনো সেই নারীকে যার স্বয়ংবর সভায় দুর্যোধন দুঃশাসন সহ বাকি কৌরবরা কিছু করতে পারেনি, কর্ণকে যে নারী অপমান করেছিলো, এই তো সুযোগ সেই নারীকে "শিক্ষা" দেওয়ার।










এরপরেই মহাভারতের সবচেয়ে কলুষিত অধ্যায় রচিত হলো, ভরা সভায় দুঃশাসন দ্রৌপদীর চুল ধরে টেনে নিয়ে এলো এবং তাকে বস্ত্রহীন করার মতো গর্হিত অপরাধের সাথে যুক্ত হলো কৌরব সহ সভায় উপস্থিত সব পুরুষ।
দ্রৌপদীর এই অপমানের জন্য কৌরবদের দায়ী করা হয়। কিন্তু যুধিষ্ঠিরও কি দায়ী ছিলেন না দ্রৌপদীর এই হেনস্তার জন্য??? অবশ্যই দায়ী যুধিষ্ঠির।
দ্রৌপদীর এই অপমান দেখে ভীম ক্রুদ্ধ হয়ে যুধিষ্ঠিরকে বলেন "শঠতার দ্বারা শত্রুরা ( কৌরবরা ) ধন সম্পত্তি এবং আমাদের জয় করেছে, তাতেও আমার ক্রোধ হয়নি কারন আপনি এই সমস্তের মালিক, আপনার যা ভালো মনে হয়েছে করেছেন। কিন্তু পাণ্ডবভার্যা দ্রৌপদীর এই অপমান প্রাপ্য নয়।কৌরবগণ আপনার দোষেই এত হীন নৃশংস কষ্ট দিচ্ছে পাঞ্চালীকে।আমি আপনার হাত দগ্ধ করবো, সহদেব অগ্নি আনো।"
অর্জুন এই সময় ভীমকে শান্ত করান।
যুধিষ্ঠিরের মতো একজন ধর্মজ্ঞান সম্পন্ন পুরুষও অহংকারে মত্ত হয়ে খেলায় জেতার নেশায় পাগল হয়ে নিজের স্ত্রীকে উপভোগ্য সামগ্রী হিসাবেই বর্ননা দেন, যা খুবই জঘন্যতম।
কিন্তু এই সভাপর্বে পৌরুষের অন্য রূপও দেখা যায়। সেই সভায় ভীষ্ম দ্রোণরা মাথা নিচু করে বসেছিলো, শুধু একজন পুরুষ দ্রৌপদীর হয়ে কথা বলেছিলো। তিনি হলেন বিকর্ণ, দুর্যোধনের ভাই। বিকর্ণ বীর হিসাবে বড় ছিলেন না কিন্তু মানুষ হিসাবে তিনি অনেক উন্নত ছিলেন সেটা বলার অপেক্ষা রাখেনা। তিনি প্রতিবাদ করে বলেন দ্রৌপদীর সাথে যা হয়েছে তা অভব্যতা। বিকর্ণ বলেন যুধিষ্ঠির অন্যায় করেছেন।
অন্তত একজন পুরুষ ছিলেন সেই সভায় পৌরুষের দেখনদারি না করে প্রতিরোধের সাহস দেখিয়েছিলেন।
দ্যুত ক্রীড়ার জন্য যা যা ঘটনা বা দুর্ঘটনা ঘটেছিলো তার জন্য যুধিষ্ঠির অনেকাংশেই দায়ী এই মেনে নেওয়া অযৌক্তিক নয় বরং তাকে ধর্মপরায়ণ বলাটাই অযৌক্তিক।
মহাভারতের কর্ণপর্বে আছে, অর্জুন যুধিষ্ঠিরকে বধ করতে চেয়েছিলেন। কি এমন ঘটনা ঘটেছিলো?
এখানেও যুধিষ্ঠিরের অতি বিজ্ঞতা দায়ী। যোদ্ধা হিসাবে খুব বড় মাপের ছিলেন না তিনি।
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের ১৭ তম দিন।কর্ণের সাথে যুদ্ধে ভালো রকম আহত হন যুধিষ্ঠির। রক্তাক্ত অবস্থায় তাকে শিবিরে নিয়ে যায় নকুল ও সহদেব।যুদ্ধক্ষেত্রে তখন ভীম ও অর্জুন প্রবল পরাক্রমে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। ভীম এই সময় অর্জুনকে যুধিষ্ঠিরের খবর নেওয়ার জন্য শিবিরে যেতে আদেশ দেন। আদেশ রক্ষা করতে যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে অর্জুন যুধিষ্ঠিরের কাছে যান।ভীম পাণ্ডব বাহিনীকে একা নেতৃত্ব দিয়ে শত্রুপক্ষের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে গেলেন।
অর্জুন ও কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরের শিবিরে পৌঁছাতেই তাদের দেখে যুধিষ্ঠির ভাবলেন অর্জুন নিশ্চয়ই কর্ণকে বধ করে সেই সুসংবাদ দিতে এসেছেন। তিনি অর্জুনের প্রশংসা পঞ্চমুখে করতে লাগলেন। কিন্তু অর্জুন যখন বলেন কর্ণ এখনো বধ হননি, জ্যেষ্ঠ ভাইয়ের খবর নিতে তিনি এসেছেন এতে যুধিষ্ঠির প্রচণ্ড রেগে গিয়ে নানা কটূ কথা অর্জুনকে বলেছিলেন। এমনকি অর্জুনের গাণ্ডীবের অবমাননা করেন। ধিক্কার জানিয়েছিলেন অর্জুনের বাহুবলের, বাণসমূহকে। নিজের অপমান মুখ বুজে মেনে নিলেও গাণ্ডীবের অপমান মানতে পারেন নি অর্জুন। কারন গাণ্ডীব লাভের পর অর্জুন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন যে তাঁর ধনুকের অপমান করবে তাকে হত্যা করবেন। তিনি রাগে তরবারি দিয়ে যুধিষ্ঠিরকে মারতে উদ্যত হন, কিন্তু কৃষ্ণের হস্তক্ষেপে সেই যাত্রায় পরিত্রাণ পান যুধিষ্ঠির।
এই ঘটনাও যুধিষ্ঠিরের জন্যই ঘটেছিলো। কেনো তিনি সবটা না জেনে অর্জুনকে এত অপ্রিতীকর অপমানজনক কথা বলতে গেলেন?
স্থিরবুদ্ধি, ধার্মিক, ন্যায়নীতি জ্ঞান অভিজ্ঞ মানুষ হিসাবে পরিচিত যুধিষ্ঠিরের কাছ থেকে এই ব্যবহার আশাতীত।
উপরোক্ত ঘটনাবলী থেকে যুধিষ্ঠিরের চরিত্রের অনেক অসঙ্গতি চোখ এড়িয়ে যায় না।

যুধিষ্ঠিরের চরিত্রের এই দিকগুলো বিচার বিশ্লেষণ করলে তাকে ধর্মাত্মা বলা কতটা যুক্তিযুক্ত????











তথ্যসূত্রঃ কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস কৃত মহাভারত।

কপিরাইটঃ রাকাশ্রী ব্যানার্জি

মন্তব্যসমূহ

you may like

রামায়ণে বর্নিত পার্শ্বচরিত্রের প্রানীসমূহ আসলে কি ছিলো??? Relevancy of the non-human characters in RAMAYANA ....

Nepotism Is as old as Mahabharata !! মহাভারতও "Nepotism" দোষে দুষ্ট ( Mahabharata Stories )

পিতৃপক্ষ ও কিছু কথা