ভীষ্মের জীবন, কর্ম ও মৃত‍্যু:- ( মহাভারত ) Bheesma from Mahabharat...




 'মহাভারত' (Mahabharat)  নামের মহাগাথাটির একটা ধারণা আমার মধ‍্যে আসার পর থেকেই একটা ব‍্যাপার বুঝেছি যে, দ্বাপর যুগের এই extraordinary 'ইতিহাস' টির যে কয়েকজন পাত্র আমাকে বিশেষভাবে ভাবিয়ে তুলেছেন, ভীষ্ম তাঁদেরই অন‍্যতম।       কুরুবংশ, মহাভারত ও দ্বাপর যুগের অন‍্যতম প্রতাপশালী পুরুষচরিত্র ও শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা হলেন দেবব্রত, যিনি ভীষ্ম নামে বেশী পরিচিত। ভীষ্ম একজন ধর্মাত্মা ও মহাভারতের অন‍্যতম একজন বিচক্ষন চরিত্র হলেও আমি খালি ভাবি, চাইলে কতকিছুইনা করতে পারতেন ভীষ্ম, এমনকি তিনি সঠিক সময়ে কৌরবদের প্রতি কঠোর হলে হয়ত মহাভারতের যুদ্ধটাই হতনা; বদলে যেত ভারতবর্ষের ইতিহাস, একেবারে অন‍্যরকম হতে পারত সেটি। কিন্তু তা হলনা, ভীষ্ম সেরকম কিছুই করলেননা! কিছু 'বস্তাপচা' sentiment আর প্রতীজ্ঞায় আটকে রইলেন সারাজীবন। তবে ভীষ্মের সুদীর্ঘ জীবনের বিস্তারিত আলোচনা করতে গেলে লেখাটিও সুদীর্ঘ হয়ে যাবে, পাঠকেরা এতে পরার ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলতে পারেন ও পাশাপাশি আমিও হয়ত লেখার ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলব। তাই যতটা সম্ভব সংক্ষিপ্ত করেই লিখলাম।
     শুরু করার আগে ছোট করে দু'টি ঘটনা বলে নেই।
     ঘটনা ১: পুরাকালে মহাভিষেক নামের এক রাজা ছিলেন যিনি কঠিন তপস‍্যাবলে 'ইন্দ্রত্ব' প্রাপ্ত করেছিলেন। একদিন ইন্দ্রের সভায় তিনি ও গঙ্গা পরস্পরকে দেখলেন; দেখা মাত্রই তাদের  মধ‍্যে, যাকে বলে love at first sight, হয়ে গেল।  স্বর্গলোকে এইরূপ ধৃষ্টতা করার অপরাধে ব্রহ্মা তাদের অভিশাপ দেন যে পরের জন্মে তারা 'মনুষ‍্য যোণী' তে স্বামী -স্ত্রী রূপে জন্ম নেবে ও স্বামী মহাভিষেক যেদিন গঙ্গার উপরে রাগ করবেন সেদিন গঙ্গা তার অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবে। যদিও  মহাভিষেক কিভাবে তার অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবেন ব্রহ্মা সেটা ভাঙলেননা।
    ঘটনা ২: একবার পৃথুপুত্র অষ্টবসুর মধ‍্যে ধূ নামের এক বসু (মতভেদে প্রভাস নামক বসু) নিজের স্ত্রীর কথায় বশিষ্ঠ মুনির 'নন্দিনী' নামের একটি গরুকে চুরি করার মত হীন কাজ করলে মুনি রাগ করে বসুদেরকে  অভিশাপ দেন তারা যেন মানুষ রূপে মৃত‍্যুলোকে (পৃথিবীতে) জন্ম নেয়; তিনি আরও বললেন, বাকি সব বসুরা এই অভিশাপ থেকে তাড়াতাড়ি মুক্তি পেয়ে গেলেও ধূ বসুটিকে অনেকদিন বেঁচে থেকে তার কৃতকর্মের শাস্তি ভোগ করে যেতে হবে। এই শুনে বসুগণতো মহা tension -এ পড়ে তাদের দুঃখের কাহিনী নিয়ে এই আশায় গঙ্গার কাছে ছুটলেন যদি গঙ্গা skillfully তাদের অভিশাপের ব‍্যাপারটি manage করে দিতে পারে। গঙ্গা সব শুনে বসুদেরকে নিজ গর্ভে ধারণ করার ও জন্মের সাথে সাথেই তাদের নদীতে প্রবাহিত করে শাপ মুক্ত করে দেবার কথা দিলেন।
    বলাই বাহুল্য যে উপরের দুটি ঘটনাই 'অতি সংক্ষিপ্ত' আকারে লিখলাম। এগুলো পরবর্তী ঘটনাগুলোকে clear করতে সাহায‍্য করবে।
    According to ঘটনা ১, ব্রহ্মার অভিশাপে সেই মহাভিষেকই পৃথিবীতে জন্ম নিলেন হস্তিনাপুরের সম্রাট শান্তনু রূপে।  (যার হাত ধরেই পরবর্তীতে মহাভারতের পথ চলা শুরু হবে।) ব্রহ্মার অভিশাপেই শান্তনুর সঙ্গে বিয়ে হল গঙ্গার। বিয়ের আগেই গঙ্গা শান্তনুর থেকে কথা নিলেন, বিয়ের পর শান্তনু যেন কোনো ভাবেই গঙ্গার কোনকাজেই হস্তক্ষেপ না করে, otherwise সে শান্তনুকে ছেড়ে চলে যাবে। বিয়ের পর গঙ্গা ও শান্তনুর আট জন পুত্র জন্মায়। জন্মাবার সাথসাথেই প্রথম সাতজন পুত্রকে গঙ্গা নদীতে 'প্রবাহিত' করে দিলেন (আটজন বসুর মধ‍্যে সাতজনের শাপমুক্তি ঘটল); এতে রেগে গেলেও কথা দিয়ে রাখার কারণে শান্তনু গঙ্গাকে কিছুই বলতে পারলেননা। কিন্তু অষ্টম পুত্রের বেলাতেও যখন একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে গেল তখন শান্তনু আর ধৈর্য‍্য রাখতে না পেরে গঙ্গাকে ধমকে নিরস্ত করে তার এই আচরনের কারণ জানতে চাইলেন। তখন গঙ্গা উপরিউক্ত ঘটনা দুটি শান্তনুকে বলে অষ্টম শিশুটিকে নিয়ে স্বর্গলোকে ফিরে গেলেন। শান্তনুর ক্রোধে গঙ্গার অভিশাপের তো পরিসমাপ্তি ঘটল কিন্তু শান্তনুকে এখনো বেশ কয়েকবছর জীবিত থাকতে হবে।   

 এই ঘটনার বেশ কয়েকবছর বাদে গঙ্গা আবার মর্ত‍্যে এসে তার ও মহারাজ শান্তনুর অষ্টম পুত্র সন্তানটিকে শান্তনুকে ফেরত দিয়ে যান। পুত্রটির নাম দেবব্রত ও বয়সে সে কিশোর। কিন্তু এই অল্প বয়সেই ধর্মজ্ঞানে, শিক্ষা-দীক্ষায় দেবব্রত ছিল highly efficient। মহারাজ শান্তনু দেবব্রতর efficiency তে মুগ্ধ হয়ে তাকে হস্তিনাপুরের যুবরাজ ঘোষনা করে দিলেন।     এই পর্যন্ত সব ঠিকই চলছিল, কিন্তু বাধ সাধলেন শান্তনু নিজে! নদী তিরের জঙ্গলে শিকার করার সময় সত‍্যবতী নামের এক অপূর্ব সুন্দরী নিষাদ (তৎকালীন ভারতবর্ষের একটি জাতি) কন‍্যার প্রেমে পড়ে গেলেন ও তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। বিয়ের আগে সত‍্যবতী ও তার  পিতা  নিষাদ রাজ শান্তনুর সামনে শর্ত রাখল, শান্তনু ও সত‍্যবতীর সন্তানই যেন পরবর্তীকালে হস্তিনাপুরের সিংহাসনে বসে। কিন্তু তিনি তো এই অধিকার already দেবব্রতকে দিয়ে রেখেছেন আর তাঁর এই সিদ্ধান্তে হস্তিনাপুর তথা সমগ্র ভারতবর্ষ খুশি। একজন 'সম্রাট' হয়ে তো তিনি নিজের প্রতিশ্রুতি বদলাতে পারেননা (তখনকার দিনে মুখের কথার দাম ছিল।  আজকের মত 'রাত গ‍্যায়ি, বাত গ‍্যায়ি' না।)। ততদিনে দেবব্রত কিশোর থেকে যুবক হয়েছেন। শান্তনু পড়লেন মহা মুশকিলে, এবার বুঝি সত‍্যবতীর সাথে বিয়েটাই আর হলনা! চিন্তায় চিন্তায় প্রায় 'আহার -নিদ্রা ত‍্যাগ' করলেন শান্তনু। পিতৃভক্ত  দেবব্রত পিতা শান্তনুর এই অবস্থা সহ‍্য করতে না পেরে নিজেই ছুটলেন নিষাদ রাজের কাছে, উদ্দেশ‍্য, সত্যবতী ও শান্তনুর বিবাহের জন‍্য নিষাদ রাজকে রাজি করানো।বললেন, 'ভবিষ্যতে দেবী সত‍্যবতী ও পিতা শান্তনুর সন্তানই  হস্তিনাপুরের সিংহাসনে বসবে আমি কোনদিনও সিংহাসন দাবি করবনা, এবার আপনি ওনাদের বিবাহে সম্মতি দিন।' শুনে নিষাদ রাজ বললেন, আপনি না হয় সিংহাসনে বসলেননা, কিন্তু 'আপনার পুত্ররাতো সিংহাসন দাবি করতেই পারে।' (আসলে  ভয়ানক উচ্চাভিলাসী  নিষাদ রাজ ও তার মেয়ে সত‍্যবতী চেয়েছিলেন বিয়েতে মত দেবার আগেই রাজ সিংহাসনে নিজেদের অধিকার secure করে নিতে।)  নিষাদ রাজের  প্রশ্ন শুনে দেবব্রতর মনে হল তার ভয় অমূলক নয়। তার কথা শুনে উত্তরে দেবব্রত যা বললেন তা অভাবনীয় ও অবিশ্বাস্য! দেবব্রত বললেন, 'যাতে ভবিষ‍্যতে আমার কোন বংশধর সিংহাসন দাবি না করতে পারে সেজন‍্য আমি আজীবন ব্রহ্মচারী ও বংশহীন থাকার প্রতিজ্ঞা নিচ্ছি; কোনদিন সিংহাসন দাবি করা তো দূর বরং এই সিংহাসনের একজন রক্ষক হয়েই আমি জীবন কাটাবো। নিজের পিতার সুখের জন‍্য সর্বভুতকে সাক্ষী মেনে আমি এই প্রতিজ্ঞা নিলাম।' কী ভীষণ প্রতীজ্ঞা! 'ভীষ্ম প্রতীজ্ঞা'! কথিত আছে, এই প্রতীজ্ঞাটি নেওয়ার পর থেকেই দেবব্রত 'ভীষ্ম' নামে সবার কাছে পরিচিত হন।  
    ভীষ্মের (এখন থেকে দেবব্রতর বদলে এই নামটাই ব‍্যবহার করব) এহেন প্রতীজ্ঞার পর নিষাদ রাজ শান্তনু-সত‍্যবতীর বিবাহে মত দিয়ে দিলেন। ভীষ্মের এরকম প্রতীজ্ঞায় শান্তনু মর্মাহত হয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু ভীষ্মের অনেক বোঝানোর পর নিজেকে   সামলে নিয়ে শান্তনু 'কৃতজ্ঞতা' স্বরূপ তাঁকে 'ইচ্ছামৃত‍্যু'র আশির্বাদ দান করেন। শান্তনুর মৃত্যুর পর ভীষ্ম নিজের প্রতিশ্রুতি মতন শান্তনু-সত‍্যবতীর পুত্র চিত্রাঙ্গদকে হস্তিনাপুরের সিংহাসনে বসালেন যদিও অল্পকাল পরেই চিত্রাঙ্গদ মারা যায়। চিত্রাঙ্গদের মৃত্যুর পরে শান্তনু-সত‍্যবতীর আরেকপুত্র বিচিত্রবীর্য‍্যকে ভীষ্ম সিংহাসনে বসান।
    Well, এই পর্যন্ত যে কয়টি বিষয় আমাদের কাছে clear সেগুলো হ'ল-
১. অষ্টবসুর সেই ধূ বা প্রভাস নামের 'অভিশপ্ত' বসুটিই দেবব্রত বা ভীষ্ম।
২. মহাভিষেকই পরজন্মে হস্তিনাপুর সম্রাট শান্তনু হন।
৩. অতি উচ্চাভিলাসী নিষাদ রাজ ও সত‍্যবতীর হস্তিনাপুরের সিংহাসনে অধিকার দাবী করার মাধ্যমেই পরবর্তীকালে হস্তিনাপুর সিংহাসনের অতজন দাবিদার উঠেছিল।
৪. বিয়ের আগে সত‍্যবতী ও নিষাদ রাজের সিংহাসন related আবদারটি শোনা মাত্রই শান্তনুর উচিত ছিল তাদের সত‍্যি কথাটা বলে কঠোর হাতে তার পরের পরিস্থিতি সামাল দেওয়া অথবা ঐরকম অন‍্যায় আবদার শোনা মাত্রই সত‍্যবতীর সাথে break-up করে নেওয়া। তাহলে  হয়ত 'মহাভারত' ব‍্যাপারটিই হতনা।
৫. Even, দেবব্রতও যদি সেদিন অতি পিতৃভক্তি না দেখিয়ে নিষাদ রাজের ওরকম প্রতীজ্ঞা না নিতেন তাহলেও হয়ত ভারতবর্ষের ইতিহাস অন‍্যরকম হত।
    হতে পারলে অনেক কিছুই positive হতে পারত কিন্তু হ'ল সবই negative (towards Indian history)!
                    "নিয়তি কে ন বধ‍্যতে!"
    যাই হোক, এর কয়েকবছর পরের একটি ঘটনা: ভীষ্ম একদিন শুনতে পেলেন কাশীর মহারাজ তাঁর তিন কন‍্যা- অম্বা, অম্বিকা ও অম্বালিকার সয়ম্বর সভার আয়োজন করেছেন কিন্ত সেই সভায় হস্তিনাপুরকে আমন্ত্রণ জানাননি। ভীষ্ম এতে প্রচন্ড insulted feel  করলেন ও রাগের বশবর্তী হয়ে অম্বা, অম্বিকা ও অম্বালিকাকে তাদের সয়ম্বর সভার থেকে 'অপহরণ'   করে নিয়ে এলেন; উদ্দেশ্য, বিচিত্রবীর্য‍্যের সাথে তাদের বিয়ে দেবেন।
    এখানেও একটা ব‍্যাপার লক্ষণীয় - ভীষ্ম যখন সত‍্যবতীকে বলেছিলেন যে তিনি কাশীর তিন রাজকুমারীকে হরণ করতে যাচ্ছেন তখন চাইলেই সত‍্যবতী ভীষ্মকে নিরস্ত করতে পারতেন, বলতেই পারতেন যা হয়েছে ভুলে গিয়ে বিচিত্রবীর্যের বিয়ের জন‍্য অন‍্য পাত্রী দেখতে; কাশীর রাজকন‍্যাদের সাথেই যে বিয়ে দিতে হবে এমনতো কোন কথা নেই। কিন্তু সত‍্যবতী তা বললেন কোথায়? তিনি তো সব শুনে ভীষ্মকে আশীর্বাদ করে বললেন, 'বিজয়ী ভব'! তাহলে কি হস্তিনাপুরকে সয়ম্বরে নিমন্ত্রণ না করায় তিনিও কাশী নরেশের উপর রুষ্ঠ হয়েই ভীষ্মকে এই গর্হিত অপরাধটা করতে দিয়েছিলেন?
    কাশী নরেশের তিন মেয়ের মধ্যে যিনি বড়, অম্বা, তিনি ভীষ্মকে জানালেন শাল্ব রাজার সাথে তার একটা love relationship আছে ও তারা পরস্পরকে স্বামী-স্ত্রী মেনে নিয়েছেন সুতরাং অপর কাউকে স্বামী হিসাবে মেনে নেওয়া তার পক্ষে  আর সম্ভব নয়। অম্বার এই কথা শুনে ভীষ্ম তার কাছে ক্ষমা চেয়ে তাকে ছেড়ে দিয়ে  শাল্বর কাছে ফিরে যেতে বললেন এবং অম্বিকা ও অম্বালিকার সাথে বিচিত্রবীর্য‍্যের বিয়ে দিলেন।
    ওদিকে শাল্ব রাজের কাছ থেকে প্রত‍্যাখাত হওয়ার পর অম্বা ভীষ্মের কাছে ফিরে এসে তাকে বিয়ে করে স্ত্রী হিসাবে গ্রহন করতে বললে ভীষ্ম নিজের বিয়ে না করার প্রতীজ্ঞার কথা তাকে জানান। ভীষ্মের এহেন কথায় চরম অপমানিত অম্বা ভীষ্মেরই অস্ত্রগুরু পরশুরামের কাছে গিয়ে তাঁকে সব খুলে বললেন ও ন‍্যায় বিচার চাইলেন। পরশুরাম তো অম্বার মুখে সব শুনে ভীষ্মের উপর বেজায় রেগে গেলেন! হস্তিনাপুরে এসে তিনি ভীষ্মকে নারী-হরণের মত জঘন‍্য ও নীচ কাজ করার জন‍্য ভর্তসনা করলেন ও আদেশ দিলেন হয় অম্বাকে ভীষ্ম বিয়ে করুক অথবা তাঁর সাথে লড়াই করুক। প্রতীজ্ঞাবদ্ধতার জন্য ভীষ্ম বিয়ে তো করতে পারবেননা, আর নিজের গুরুর বিরুদ্ধে লড়বেনই বা কিভাবে? অথচ গুরুর আদেশ অমান‍্য করারও উপায় নেই। অবশেষে ভীষ্ম লড়লেন। পরশুরাম ও ভীষ্মের মধ্যে সেই যুদ্ধ ২১ দিন ধরে চলল অমীমাংসিত ভাবে; ২১ দিন পরে যখন মুনি-ঋষিরা এসে পরশুরামকে ভীষ্মের ব‍্যাপারে সব সত‍্যি জানালেন তখন পরশুরাম যুদ্ধে যতি টেনে সেখান থেকে চলে গেলেন। অম্বা এই ঘটনায় আরো কয়েকগুণ রেগে গিয়ে ভীষ্মকে বললেন, 'তুমি আমার থেকে আমার প্রেম কেড়ে নিয়েছ। তোমার জন‍্যই আজকে শাল্বরাজ আমাকে গ্রহন করলেননা;    এমনকি তুমিও আমাকে বিয়ে করতে রাজী সবই  এখন আত্মহত্যা করা ছাড়া আমার কাছে আর কোন উপায় নেই। কিন্তু যেভাবে তুমি এই জন্মে আমার জীবন নষ্ট করে আমাকে মৃত‍্যুবরণ করতে বাধ‍্য করলে ও আমার মৃত্যুর কারণ হলে ঠিক সেভাবেই পরের জন্মে আমিও তোমার মৃত্যুর কারণ হ'ব।' এইরকম deadly warning শোনার পরেও ভীষ্ম হাতজোড় করে অম্বাকে বললেন পরের জন্মে যখন অম্বা ভীষ্মের সামনে আসবেন তখন তিনি নিজে থেকেই সমস্ত অস্ত্র পরিত‍্যাগ করে মৃত‍্যুবরণ করবেন।
    এইখানে একটা প্রশ্ন মনে জাগে, ভীষ্ম সেদিন অম্বাকে আত্মহত‍্যার মত একটা মহাপাপ করতে দিয়েছিলেন কেন?  তিনি আরেকটু চেষ্টা করলেই হয়ত অম্বাকে অপহরণ করার কারণ ও বিবাহ না করতে চাওয়ার কারণ বোঝাতে পারতেন। ব‍্যাপারটা কঠিন হলেও অসম্ভব ছিলনা তাঁর কাছে।
    আসলে ভীষ্ম চেয়েছিলেন, নিজে অবিবাহিত থেকে, কোনরকম পিছুটান না রেখে একাগ্রচিত্তে নিজের প্রতিশ্রুতি পালন করে যেতে ও ধর্মত-ন‍্যায‍্যত হস্তিনাপুরের সিংহাসনকে রক্ষা করে যেতে। যদিও এতে ভীষ্মের সফলতার তুলনায় অসফলতার পরিমাণ অনেক বেশী।

Cut to Hastinapur:
    বিবাহের পরেই ও কোন সন্তান জন্মাবার আগেই বিচিত্রবীর্য‍্য দেহ রাখলেন। এবার সত‍্যবতী ভীষ্মকে request করলেন অম্বিকা ও অম্বালিকাকে বিবাহ করে কুরুবংশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। কিন্তু ভীষ্ম এবারও রাজী হলেননা, কারণ সত‍্যবতীর পিতার সামনে করা তাঁর সেই প্রতীজ্ঞা। বাধ‍্য হয়ে সত‍্যবতী তার কুমারী অবস্থার পুত্র ব‍্যাসদেবকে (Satyabati's son through rishi Parashar) ডেকে পাঠালেন 'নিয়োগ' প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অম্বিকা ও অম্বালিকার গর্ভে পুত্র সন্তান 'দান' করার জন‍্য। (তখনকার দিনে স্ত্রী-পুরুষের যৌন সংযোগ না ঘটিয়ে সন্তান উৎপন্ন করার পদ্ধতিটিকেই নিয়োগ পদ্ধতি বলত যা অনেকাংশে আজকের যুগের taste tube baby-র পদ্ধতিটির সঙ্গে মেলে।) এইভাবেই অম্বিকার গর্ভে ধৃতরাষ্ট্র, অম্বালিকার গর্ভে পান্ডু ও তাদের এক দাসীর গর্ভে বিদূরের জন্ম হল।
    অম্বিকার পুত্র ধৃতরাষ্ট্র  জন্মান্ধ হওয়ায় বিদূরের পরামর্শে অম্বালিকার পুত্র পান্ডু সিংহাসনে বসলেন। রাজমাতা সত‍্যবতীর কথামতো ভীষ্ম ধৃতরাষ্ট্রের বিবাহের জন‍্য গান্ধার রাজ‍্যের রাজা সুবলের কাছে এসে তাঁর কন‍্যা রাজকুমারী গান্ধারীর 'পাণী প্রার্থনা করলেন। হস্তিনাপুরের সাথে সন্মন্ধ হওয়ার কথা ভেবে রাজা সুবল খুশি মনেই বিয়েতে সায় দিয়ে দিলেন। এখানে দ্রষ্টব‍্য, ভীষ্ম কিন্তু সুবলের কাছে ধৃতরাষ্ট্রের অন্ধত্বের ব‍্যাপারটি ভাঙলেননা। বিয়ের পর সেটি জানতে পেরে সুবল ও গান্ধারী দূ'জনেই প্রচণ্ড ভেঙে পড়লেন। এখান  থেকে আরেকটা ব‍্যাপার পরিষ্কার যে ভীষ্ম সত‍্য গোপন  করে ধৃতরাষ্ট্রের সাথে গান্ধারীর বিবাহ দিয়েছিলেন।
    আরেকটা ঘটনা বলি, গান্ধারীর কুষ্ঠিতে তার মাঙ্গলিক হওয়ার যোগ ছিল যার জন‍্য দোষ কাটাতে প্রতীক রূপে তার বিয়ে প্রথমে একটি ছাগলের সাথে দেওয়া হয়। রাজা সুবলও কিন্তু এই কথা ভীষ্মকে আগে বলেননি। সুবল হয়তো ভেবেছিলেন গান্ধারীর মাঙ্গলিক দোষতো কেটেই গেছে তাই এই কথা আর ভীষ্মকে বলার কোন প্রয়োজন নেই, উপরন্তু ভীষ্ম যদি এতে রেগে গিয়ে বিয়ে নাকচ করে দেন তাহলে হয়ত হস্তিনাপুরের সাথে সন্মন্ধ করার গৌরব তিনি হারাবেন।
    সুতরাং দেখা যাচ্ছে ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারীর বিবাহের আগে দু'পক্ষই কিছু না কিছু লুকিয়ে ছিল। যদিও এখানে ধৃতরাষ্ট্রর অন্ধত্বের ব‍্যাপারটা লুকোনো বেশী অপরাধের ছিল কারণ গান্ধারীতো ইতিমধ্যেই নিজের দোষ কাটিয়ে উঠেছিল।
    যাই হোক, বিয়ের পরে ভীষ্ম যখন জানতে পারলেন যে,  গান্ধারীর আগেও একটি বিবাহ করা আছে তখন তিনি রাগে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূণ‍্য হয়ে গান্ধার রাজ‍্য আক্রমণ করে সুবলসহ গান্ধারের রাজপরিবারকে বন্দী বানিয়ে ফেলে আবার নিজের ক্ষমতার অপব‍্যবহার করলেন। বন্দী অবস্থায় গান্ধার রাজপরিবারকে অতি অল্প পরিমাণে খাওয়ার দেওয়া হত যা দিয়ে পরিবারের কারোরই পেট ভরতনা। কথিত আছে, সেই অবস্থায় রাজা সুবল ও তার স্ত্রী নিজেদের ভাগের খাবারও তাদের পুত্র শকুনিকে খাইয়ে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন যাতে পরবর্তীকালে শকুনি তার বোন গান্ধারী ও তাদের পরিবারের সাথে ঘটে যাওয়া অন‍্যায়ের শোধ তুলতে পারে। শকুনি সেই প্রতিশোধ কিভাবে তুলেছিলেন সেটা 'আট থেকে আশি' সবার জানা। কিন্তু শকুনিকে এই শোধ তুলতে যে ভীষ্মই বাধ‍্য করেছিল সেটা খুব কম মানুষেরই জানা!
    হস্তিনাপুর সিংহাসনের প্রতি ভীষ্মের একচোখামী ও রাজপরিবারকে নিয়ে 'মিথ্যা' অহংকার ভারতবর্ষকে একটা রাস্তা দেখিয়েছিল পরবর্তীকালে যেই রাস্তা কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের মাঠে গিয়ে শেষ হয়।
   এর কয়েক বছর পরে কুন্তী যখন তাঁর পাঁচ পুত্রকে নিয়ে হস্তিনাপুরে ফিরে এলেন তখন শকুনিই পান্ডুপুত্রদের 'পান্ডব' ও ধৃতরাষ্ট্র পুত্রদের 'কৌরব' নামে অভিহিত করে অনধিকার ভাবে আলাদা করেছিলেন। তবুও যাতে দু'পক্ষের ভাইদের মধ‍্যে হৃদ‍্যতা বজায় থাকে তাই ভীষ্ম কুরুবংশে শকুনীর এই অনধিকার হস্তক্ষেপে কিছু বললেনা বা কোনপ্রকার বিরোধও করলেননা। কিন্তু তখন ভীষ্মের এমনটাই করা উচিত ছিল; ভীষ্ম যদি তখনই দুই তরফের ভাইদের কড়া ভাবে বলতেন, 'তোমরা সবাই একই বংশের সন্তান তাই তোমাদের মধ্যে কোনপ্রকার বৈরিতা মানায়না' তাহলে হস্তিনাপুরের সিংহাসন নিয়ে 'কৌরব-পান্ডব' এমন পর্যায়ে পৌঁছতনা। যদিও তিনি এমনটা না করে শকুনীর এই অনধিকার বিভাজনে চুপ থাকলেন। আর সবাই জানে, 'মৌনং সম্মতি লক্ষণম!'
    ছেলেবেলাতেই বাবাকে হারানো 'পান্ডব' দের প্রতি ভীষ্মের স্নেহ একটু বেশীই ছিল। ধৃতরাষ্ট্রও ভ্রাতুষ্পুত্রদের মধ‍্যে নিজের ভাইকে দেখতে পেতেন। এই নিয়েও শকুনী কৌরব ভাইদের মনে পান্ডব ভাইদের সম্পর্কে বিষ ঢালতেন। বাল‍্যাবস্থাতেই শকুনীরই প্ররোচনায় দূর্যধন & co. ভীমকে বিষ খাইয়ে হত‍্যার চেষ্টা করেছিল, ব‍্যাপারটা পরে ভীষ্ম থেকে কুন্তী সবাই জেনে গিয়েছিলেন কিন্তু রাজপরিবারের এই কেচ্ছা যাতে বাইরে ফাঁস না হয়ে যায় তারজন‍্য ধৃতরাষ্ট্র সাত তাড়াতাড়ি ব‍্যাপারটাকে ধামাচাপা দিয়ে কুন্তী ও পান্ডবদের ঘটনাটা মন থেকে মুছে ফেলতে বললেন। আসলে দূর্যধন ও কৌরবদের উপরে স্বাভাবিক ভাবেই ধৃতরাষ্ট্রের টান ছিল  আলাদ রকমের বেশী। ভীষ্ম কিন্তু গোটা ব‍্যাপারটা জেনেও শকুনী বা কৌরবদের তেমন কিছু বললেননা! শুধুমাত্র অল্প-স্বল্প শাস্তি আর ধমক দিয়েই নিরস্ত হলেন। চাইলে শকুনীকে তিনি এই কাজের জন‍্য কঠিন শাস্তি দিতে পারতেন, হস্তিনাপুর থেকে চিরতরে বিতাড়িত করতে পারতেন; এতে হয়ত ভবিষ্যতে কুরুবংশের ইতিহাসও অন‍্যরকম হতে পারত।
    শকুনীর এইরকম কুপ্ররোচনা 'পাথেয়' করে তখন দূর্যধনরা অনেকটা বড় হয়েছে ও বড় হওয়ার সাথে সাথে বিভিন্ন অপকর্ম করে হস্তিনাপুরের ক্ষতি করে যাচ্ছে ; ভীষ্ম সব দেখছেন, বুঝছেন কিন্তু শকুনী তথা দূর্যধনদের কিছুই বলছেননা, ধৃতরাষ্ট্রের কাছে তাদের অভিযোগ করে যাচ্ছেন শুধু। এবার শকুনীর plan মত দূর্যধনরা চেষ্টা করল পান্ডবদের পুরিয়ে মারার। কপাল ভালো থাকার জন‍্য পান্ডবরা সেযাত্রায় বেঁচে গেল। আবার ধৃতরাষ্ট্র শকুনী ও দূর্যধনদের এই দুষ্কর্ম ধামাচাপা দেওয়ার জন‍্য উঠেপরে লাগলেন, ভীষ্মও তাদের সেরকম কিছু বললেননা।
    এরও কয়েকবছর পরে কৌরবদের আমন্ত্রণে ইন্দ্রপ্রস্থ থেকে পান্ডবরা সস্ত্রীক হস্তিনাপুর রাজসভায় এলেন। শকুনীর প্ররোচনায় তাঁরা কৌরবদের সাথে পাশা খেলতে বসলেন।  পাশাখেলায় পান্ডবরা যখন একে একে নিজেদের সবকিছু কুটিল শকুনীর কাছে হারলেন তখন শেষ দানে তারা দ্রৌপদীকে বাজি রেখে তাঁকেও হারলেন। দূষ্ট দূর্যধন দ্রৌপদীকে বাজিতে জেতার পর তাঁর বস্ত্রহরন করার চেষ্টা করল কিন্তু গান্ধারী আর বিদূরের প্রতিবাদ করায় ধৃতরাষ্ট্র দূর্যধনকে নিরস্ত করলেন ও দ্রৌপদী তথা পান্ডবদের  হেরে যাওয়া সবকিছু ফিরিয়ে দিয়ে তাঁদের ইন্দ্রপ্রস্থ ফিরে যেতে বললেন। লক্ষণীয়,  এত কিছু ঘটার সময় রাজসভায় ভীষ্মও উপস্থিত ছিলেন, কিন্ত তিনি এবারও কিছুই বললেননা। এমনকি দ্রৌপদীর বস্ত্রহরনের মত নীচ ও ঘৃণ‍্য কাজ হতে দেখেও দূর্যধন বা শকুনীর বিরুদ্ধে তেমনভাবে মুখই খুললেননা ভীষ্ম; ধৃতরাষ্ট্রকে উদ্দেশ্য করে শুধু প্রলাপই করে গেলেন। পঞ্চপান্ডব ও দ্রৌপদী আশা করেছিলেন ভীষ্ম এবার হয়তো তাঁদের হয়ে কথা বলবেন, কিন্তু শকুনী বা দূর্যধনদের প্রতি তিনি যখন নীরব থাকলেন তখন মুখে কিছু না বললেও পান্ডবরাও কি তাঁর প্রতি রুষ্ঠ হননি? সভা থেকে পান্ডবরা চলে যেতেই দূর্যধন তীব্র ভর্তসনা করে উঠলেন পিতা ধৃতরাষ্ট্রকে। পুত্রস্নেহে 'অন্ধ' ধৃতরাষ্ট্র বাধ‍্য হয়ে লোক পাঠিয়ে মাঝপথ থেকে পান্ডবদের আবার ধরে নিয়ে আসালেন হস্তিনাপুর রাজসভায়। পিতামহ ভীষ্ম কিন্তু তখনও চুপ। শুধু প্রলাপ করে যাচ্ছেন কিন্তু শকুনী-দূর্যধন-দূঃশাসনদের প্রতি কোন rectifying action নেই! যেটা সেই সভার senior most ব‍্যাক্তি হওয়ায় তাঁর থেকে কাম‍্য ছিল।
    পান্ডবরা আবার এলেন, পাশা খেললেন, হারলেন ও বনবাসের দন্ড পেলেন।....ভীষ্ম এখনও চুপ। ধন‍্যি তাঁর 'ভীষ্ম প্রতীজ্ঞা'!
    দূর্যধন তথা কৌরবদের সামলানোর, পান্ডবদের সাথে তাদের বৈরিতা হতে না দেওয়ার, হস্তিনাপুরের ভবিষ্যৎ কে চুরমার হতে না দেওয়ার বা সময় থাকতেই শকুনীকে হস্তিনাপুর থেকে নিষ্কাশিত করার যতগুলো সুযোগ মহামহিম ভীষ্ম পেয়েছিলেন তেমনটা আর কেউ পায়নি। কিন্তু বারবার তিনি তাঁর 'দায়বদ্ধতা'র কাছে আটকে যেতেন; সময়ের সাথে সাথে তিনি সেগুলোকে বদলাবার কথাও ভাবেননি।
    এর অনেকবছর পরে যখন কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধ শুরু হল তখন সেই দায়বদ্ধতার জন‍্যই তিনি কৌরব পক্ষে লড়লেন। যুদ্ধের প্রথম দু-এক দিন পান্ডবদের বাগে পেয়েও ভীষ্ম তাঁদের বধ না করে ছেড়ে দিচ্ছিলেন। দূর্যধন ব‍্যাপারটা notice করে ভীষ্মকে ভর্তসনা করে বলল, 'পান্ডবরা আপনার প্রিয় বলেই আপনি তাদের মারছেননা। অথচ এমন একচোখামো করা আপনার সাজেনা।' কারন ভীষ্ম তো যে কোন মূল‍্যে, যে কোন পরিস্থিতিতে হস্তিনাপুর সিংহাসন রক্ষার্থে রাজপরিবারের পাশে থাকবেন বলে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।  কিন্ত পান্ডবদের প্রতি অপত‍্য স্নেহের কারনে তিনি তো তা করছেনইনা, উল্টে শত্রুপক্ষকে দয়া দেখাচ্ছেন! - কোনো যোদ্ধার থেকেই এরকম আচরণ মেনে নেওয়া যায়না। দূর্যধনের বক্তব্য শুনে ভীষ্ম খানিকটা লজ্জিত ও খানিকটা রাগত হলেন। মন্ত্রবলে তিনি পাঁচটি তীর নিয়ে এসে দূর্যধনকে বললেন আগামীকাল এই তীর পাঁচটি দিয়েই তিনি পঞ্চপান্ডবদের বধ করবেন। যদিও ভীষ্মের কথায় দূর্যধনের খুব একটা বিশ্বাস হলনা সে তীর গুলো সে রাতে নিজের কাছে রেখে দিয়ে বলল পরেরদিন যুদ্ধক্ষেত্রে ভীষ্মকে সেগুলো ফিরিয়ে দেবেন। ঐ তীর গুলোতে পান্ডবরা মারা পড়ত ঠিকই, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এটা আঁচ করতে পেরে অর্জূনকে পাঠিয়ে দূর্যধনের থেকে সেগুলো নিয়ে আসালেন (কোন একটা কারনে দূর্যধন অর্জূনের কাছে তাঁকে তাঁর ইচ্ছামত যেকোনো একটা উপহার দেওয়ার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন; তবে সে ঘটনা অন‍্য ও এখানে সেটা আলোচনা করা অপ্রাসঙ্গিক)। শ্রীকৃষ্ণের উপস্থিত বুদ্ধিতে নিশ্চিত মৃত্যুর (ভীষ্ম) হাত থেকে সেই যাত্রায় পান্ডবেরা রক্ষা পেলেন; কিন্তু তার সাথে এটাও বুঝলেন যে ভীষ্ম জীবিত থাকলে তাঁরা এই যুদ্ধ জীবনে জিততে পারবেননা। কারণ শ্রীকৃষ্ণ জানতেন, পান্ডবরা পাঁচ ভাই তাঁদের শ্রদ্ধেয় পিতামহ কে কোনভাবেই আক্রমণ করবেননা উপরন্তু ভীষ্ম 'ইচ্ছামৃত‍্যু'র বরদান প্রাপ্ত। আবার সেই শ্রীকৃষ্ণের কথামতই পঞ্চপান্ডবেরা ভীষ্মের camp এ ছুটলেন তাঁর কাছ থেকে তাঁরই মৃত‍্যুর উপায় শুনতে। ভীষ্ম নিজেও যুদ্ধে পান্ডবদের জয় চাইছিলেন তাই পান্ডবদের অম্বার ঘটনাটি  বলে বললেন, এই জন্মে অম্বা পাঞ্চালরাজ দ্রুপদের কন‍্যারূপে জন্ম নিয়েছেন। এ জন্মে তাঁর নাম হয়েছে শিখন্ডিনী। তাঁকে একবার যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত করতে পারলে ভীষ্ম তাঁর সামনে অস্ত্র সমর্পন করবেন। সেইসময় পান্ডবেরা তাঁকে বধ করতে সমর্থ হবেন।  

   শ্রীকৃষ্ণের চেষ্টায় পাঞ্চাল দেশের বড় রাজকুমারী শিখন্ডিনীকে এক দিনের জন‍্য লিঙ্গ পরিবর্তন করিয়ে কুরুক্ষেএ যুদ্ধের মাঠে নিয়ে আসা হ'ল; কারণ সেযুগে নারীদের যুদ্ধস্থলে প্রবেশ করা নিষিদ্ধ ছিল। লিঙ্গ পরিবর্তন করার পরে তার নাম হয়েছিল শিখন্ডি।
    কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ জয়ের পর শ্রীকৃষ্ণকে নিয়ে পান্ডবেরা ভীষ্মের কাছে আশীর্বাদ নিতে এলেন, ভীষ্ম তাঁদের আশীর্বাদ করে ও তাঁর করা ভুলের জন‍্য পান্ডব তথা দ্রৌপদীর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। শ্রীকৃষ্ণের কাছে তিনি জানতে চাইলেন তাঁর করা ঠিক কোন দোষটার জন‍্য তাঁকে এভাবে শরশয‍্যা পেতে হল! অর্থাৎ, 'কর্মফল' সন্মন্ধে তাঁরও ধারণা স্পষ্ট ছিল।
    নিজের জীবনে ভীষ্ম একধারে যেমন অনেক পূণ‍্যের কাজ করেছিলেন, অন‍্যদিকে তেমনই পাপ কাজও অনেক করেছিলেন। তাঁর কৃত অপকর্মের জন‍্য তিনি তাঁর জীবদ্দশাতে অনেক কষ্ট ভোগতো করেছিলেন বটেই এমনকি পূর্ব কোন এক জন্মে করা কোন ভুলের শাস্তিও তাঁকে এই জন্মেই পেতে হয়েছিল।
    ভীষ্মের জীবন কাহিনী আরো একবার প্রমাণ করে দেয় যে কর্মফল একটি প্রমাণিত সত‍্য আর এই সত‍্য কাউকে ছাড়েনা। এমনকি শ্রীকৃষ্ণকেও এই কর্মফল ছাড়েনি (যদিও সেই প্রসঙ্গ এখানে আলোচনা করবনা)। মহাভারতের অন‍্যান‍্য চরিত্র গুলোর মত ভীষ্মের জীবনেরও সারমর্ম এটাই যে, ভালো ফল পেতে হলে আমাদের ভালো কাজই করে যেতে হবে।

   'পিতামহ', শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, 'আজ থেকে অনেকবছর আগে আপনার পূর্ব কোন এক জন্মে আপনি কোন এক রাজপুত্র ছিলেন। সেই রাজপুত্র একদিন  ঘোড়ায় চড়ে এক বনের মধ‍্যে শিকারে বেরোলো। বনের মধ‍্যে একটি গাছ থেকে একটি শূঁয়োপোকা ঘোড়াটির উপর পড়ে। রাজপুত্র সেটিকে তুলে পিছনের দিকে ফেলে দিলেন কিন্তু পিছন ফিরে একবার দেখলেনওনা শূঁয়োপোকাটির কী হ'ল! শূঁয়োপোকাটি একটি কাঁটাঝোপের উপর চিৎ হয়ে পড়ল, ঝোপের সমস্ত কাঁটা পোকাটির সর্বাঙ্গে বিঁধে গেল। এই অবস্থায় শূঁয়োপোকাটি ৫৮ দিন বেঁচে ছিল এবং সেই ৫৮ দিনের প্রতিমুহূর্তেই ভগবানকে বলতে থাকল তার এই অবস্থা যে করেছে, সেও যেন একইভাবে মৃত‍্যুপ্রাপ্ত হয়। আপনার এজন্মে আপনি সেই শাস্তিটি পেলেন মহামহিম।'     সারা কুরুক্ষেত্রে তখন pin drop silence। ধূ (বা মতভেদে প্রভাস) নামের সেই বসুটির বোধহয় শাপমুক্তি ঘটল এতদিনে কারণ সূর্যের উত্তরায়ন শুরু হওয়ার সাথে সাথেই পিতামহ ভীষ্ম মৃত‍্যুবরণ করেছেন। আর তাঁর সাথেই মৃত‍্যুবরণ করলেন দ্বাপর যুগের অন‍্যতম মহাপ্রতাপী ও অন‍্যতম শ্রেষ্ঠ এক যোদ্ধা।
অর্জুনের রথে চেপে শিখন্ডি ভীষ্মের মুখোমুখি হলেন, ভীষ্মও তাকে দেখে চিনতে পেরে তাঁর প্রতিশ্রুতি মতো নিজের অস্ত্র পরিত‍্যাগ করলেন। ঠিক এই সময়ে পান্ডবেরা ভীষ্মকে লক্ষ‍্য করে তীর নিক্ষেপ করলেন; একটা নয়, শয়ে শয়ে তীর - যেগুলো ভীষ্মের শরীরকে এফ‍োঁড়-ওফোঁড় করে দিল। বাণের আঘাতে ভীষ্ম নিজের রথ থেকে পড়ে গিয়ে 'শরশয‍্যা' প্রাপ্ত হলেন...কিন্তু তৎক্ষণাৎ মৃত‍্যুবরণ করলেননা। মাটিতে পড়ার সময় ভীষ্মের মুখ নাকি সূর্যের দিকে ছিল, তিনি দেখলেন সূর্যের তখন দক্ষিণায়ন চলছে অর্থাৎ সময়টা মৃত‍্যুর উপযুক্ত নয়। ভীষ্ম স্থির করলেন আজ থেকে ৫৮ দিন পর যখন সূর্যের উত্তরায়ন শুরু হবে তখন ভীষ্ম মৃত‍্যুর ইচ্ছা  প্রকাশ করবেন। ততদিন শরশয‍্যায় শুয়ে নিজের করা ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করবেন।









মন্তব্যসমূহ

you may like

রামায়ণে বর্নিত পার্শ্বচরিত্রের প্রানীসমূহ আসলে কি ছিলো??? Relevancy of the non-human characters in RAMAYANA ....

Nepotism Is as old as Mahabharata !! মহাভারতও "Nepotism" দোষে দুষ্ট ( Mahabharata Stories )

পিতৃপক্ষ ও কিছু কথা